নেত্রকোণার পাঁচ পলাতক রাজাকারের ফাঁসির রায়

একাত্তরে নেত্রকোণার পূর্বধলায় অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের মত মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার দায়ে পলাতক পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় এসেছে যুদ্ধাপরাধ আদালতে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 March 2019, 06:14 AM
Updated : 28 March 2019, 03:52 PM

বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে।

পলাতক এই পাঁচ আসামি হলেন- শেখ মো. আব্দুল মজিদ ওরফে মজিদ মাওলানা, মো. আব্দুল খালেক তালুকদার, মো. কবির খান, আব্দুস সালাম বেগ ও নুরউদ্দিন।

একাত্তরে তারা নেজামে ইসলামী ও মুসলিম লীগের মত স্বাধীনতাবিরোধী দলের সদস্য হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান বলে উঠে এসেছে এ মামলার বিচারে।

২৪০ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত বলেছে, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে। এছাড়া একটি অভিযোগে তিন আসামির আমৃত্যু কারাদণ্ড।

এ মামলায় সাত আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু অভিযোগ গঠনের আগেই কারাগারে অসুস্থ হয়ে মারা যান আসামি আহাম্মদ আলী (৭৮)।  আর যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় মারা যান আরেক আসামি আব্দুর রহমান (৭০)। ফলে পলাতক পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে বিচার কাজ শেষে আদালত বৃহস্পতিবার রায় দিল। 

ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম রায়ের পর্যবেক্ষণে পলাতক পাঁচ আসামির বিষয়ে বলেন, “আত্মসমর্পণের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরও বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধা দেখিয়ে তারা আত্মসমর্পণ করেননি। তাদের এই পলায়নপরতাই প্রমাণ করে যে, তারা অপরাধ করেছেন। সে অপরাধবোধ থেকে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। না হয় তারা বিচার মোকাবেলা করতেন।’

রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলেছেন, এই রায়ে ন্যায়বিচার হয়নি বলেই তিনি মনে করেন।  

এই রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবেন আসামিরা। তবে সেজন্য তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে।

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আসামিদের মধ্যে মজিদ মওলানা মুক্তিযুদ্ধের সময় নেজামে ইসলামীর নেতা হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করতেন।

খালেক তালুকদার একাত্তরে মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। পরে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে সর্বশেষ তিনি পূর্বধলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হন।

কবির খান মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি উপজেলা বিএনপির সদস্য ছিলেন।

আব্দুস সালাম বেগ ও নুরউদ্দিনও মুক্তিযুদ্ধের সময় মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। সর্বশেষ বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন তারা।

মানবতাবিরোধী অপরাধের সাত অভিযোগে অভিযুক্ত করে ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল তাদের বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৩৬টি মামলার ৯২ আসামির মধ্যে পাঁচজন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট ৮৫ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৮ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে।

কোন অভিযোগে কী সাজা

 

অভিযোগ

আসামি

সাজা

পূর্বধলার রাজপাড়ায় হামলা, লুটপাট, হেমসুন্দর বাগচী, হরিদাস সিং ও মেঘনাথকে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যা

শেখ মো. আব্দুল মজিদ

মো. আব্দুল খালেক তালুকদার

মো. কবির খান

আমৃত্যু কারাদণ্ড

পূর্বধলার বারহা গ্রামের আবদুল গণী সরকারকে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন 

শেখ মো. আব্দুল মজিদ

মো. আব্দুল খালেক তালুকদার

১০ বছরের সাজা

 

পূর্বধলার বারহা গ্রামে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, আবদুল খালেক তালুকদারকে অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা

শেখ মো. আব্দুল মজিদ

মো. আব্দুল খালেক তালুকদার

মৃত্যুদণ্ড

পূর্বধলার বারহা গ্রাম থেকে মহির উদ্দিনকে অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা

শেখ মো. আব্দুল মজিদ

মো. আব্দুল খালেক তালুকদার

আব্দুস সালাম বেগ ও মো. নুরউদ্দিন

মৃত্যুদণ্ড

পূর্বধলার বিভিন্ন গ্রামে হামলা চালিয়ে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা

শেখ মো. আব্দুল মজিদ

মো. আব্দুল খালেক তালুকদার

মো. কবির খান

আব্দুস সালাম বেগ ও মো. নুরউদ্দিন

মৃত্যুদণ্ড

পূর্বধলার পূর্ব মৌদাম গ্রামে হামলা চালিয়ে লুটপাট, ভাংচুর এবং হাজি সিরাজ মণ্ডলকে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা

শেখ মো. আব্দুল মজিদ

মো. আব্দুল খালেক তালুকদার

মো. কবির খান

আব্দুস সালাম বেগ ও মো. নুরউদ্দিন

মৃত্যুদণ্ড

 

পূর্বধলার পূর্ববুদি গ্রামে জামিলা খাতুনকে ধর্ষণ

শেখ মো. আব্দুল মজিদ

মো. আব্দুল খালেক তালুকদার

মো. কবির খান

মৃত্যুদণ্ড

 

মামলা বৃত্তান্ত

নেত্রকোণার পূর্বধলার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদির একাত্তরে তার বড় ভাই আব্দুল খালেককে হত্যার ঘটনায় ২০১৩ সালে একটি মামলা দায়ের মামলা করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ২১ অগাস্ট বাড়হা গ্রামে আব্দুল খালেককে গুলি করে হত্যার পর কংস নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয় ওই মামলায়।

পরে মামলাটি পাঠানো হয় ট্রাইব্যুনালে। প্রসিকিউশনের তদন্ত কর্মকর্তা শাহজাহান কবির ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে পরের বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত মামলাটি তদন্ত করেন।

২০১৬ সালের ১৬ মার্চ তিনি প্রসিকিউশনে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। যাচাই বাছাই শেষে ২২ মে প্রসিকিউশন ট্রাইব্যনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে।

সেখানে আটজনকে অপহরণের পর হত্যা, তিনটি বাড়ির মালামাল লুট, আটটি ঘরে অগ্নিসংযোগ ও একজনকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।

তদন্ত চলার মধ্যেই প্রসিকিউশনের আবেদনে ট্রাইব্যুনাল সাতজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাদের মধ্যে আহম্মদ আলী ও আব্দুর রহমানকে ২০১৫ সালের অগাস্টে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে কারাগারে থাকা অবস্থায় তাদের দুজনের মৃত্যু হয়।

বাকি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয় ২০১৭ সালের এপ্রিল। ওই বছর ১২ জুন শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।

রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলার প্রসিকিউটর ছিলেন মোখলেছুর রহমান বাদল ও সাবিনা ইয়াসমিন মুান্নি। পলাতক পাঁচ আসামিদের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম।

রাষ্ট্রপক্ষে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও কয়েকজন ভিকটিমসহ ২৬ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি উভয়পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে।

প্রতিক্রিয়া

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল সাংবাদিকদের বলেন, ‘হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুট, অগ্নিসংযোগ, বিনাশের মত মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ে আসামিদের বিরুদ্ধে আনা সাতটি অভিযোগই প্রসিকিউশন উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে সন্দোতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। যে কারণে ট্রাইব্যুনাল আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছে। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।”

বাদল বলেন, আসামিদের মধ্যে আব্দুল মজিদ ওরফে মজিদ মওলানা, আব্দুল খালেক তালুকদার এবং মো. কবির খানের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ছিল। সাত অভিযোগের মধ্যে সর্বশেষ অভিযোগটি ছিল ধর্ষণের।

“ওই অভিযোগটিও আমরা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছি। ধর্ষিত ভিকটিমসহ চারজন আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে।”

আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল বলেন, “আদালত ধর্ষণের বিষয়ে বলেছেন, ‘যুদ্ধের সময় বিশেষ করে রেপ হল হত্যার চাইতে নিষ্ঠুরতম অপরাধ।”

অন্যদিকে আসামিপক্ষের রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম সাংবাদিকদের বলেন, “স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আসামিদের এ মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। আমি মনে করি আসামিরা ন্যয়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

“তারা যদি আদালত, আইন-বিচারের প্রতি আস্থা রেখে বা শ্রদ্ধা দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করেন, রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন, তাহলে তারা খালাস পাবেন বলে আমি মনে করি।”