একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি না পেলে পুনরাবৃত্তির শঙ্কা

একাত্তরের গণহত্যার বৈশ্বিক স্বীকৃতি যদি না মিলে তবে ইতিহাসে তার পুনরাবৃত্তির শঙ্কা থেকেই যাবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই আকুতি জানালেন স্বজনহারা পরিবারগুলো।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2019, 05:37 PM
Updated : 25 March 2019, 05:42 PM

একাত্তরের ২৫ মার্চের সেই কালরাত স্মরণে বাংলাদেশজুড়ে নানা কর্মসূচি পালনের মধ্যে সোমবার আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এই আকুতি ঝরে তাদের।

ন্যায়সঙ্গত অধিকারের দাবিতে সোচ্চার এই ভূখণ্ডের মানুষকে স্তব্ধ করে দিতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এক রাতেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন নিরস্ত্র হাজারো মানুষ।

ওই নির্যাতন বাঙালিদের প্রতিরোধ যুদ্ধে দিকে ঠেলে দেয়। নয় মাস ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা চলার মধ্যে প্রতিরোধের সংগ্রামীদের বিজয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ।

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সেই বর্বরতা স্মরণে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ গণহত্যা দিবস পালনের পাশাপাশি বিশ্বজুড়েই যেন দিনটি পালিত হয়, তাতে সচেষ্ট আওয়ামী লীগের সরকার।

তার ধারাতেই আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির আয়োজনে হয় আলোচনা অনুষ্ঠানটি, এতে একাত্তরে গণহত্যার শিকার পরিবারগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও ছিলেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরী একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি চেয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেন, “যদি এটাকে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি আমরা না দিই, তাহলে তা হবে ভবিষ্যতে এই ধরনের গণহত্যা ঘটার দরজা খোলা রাখা।

“একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি যদি মিলত, তবে রুয়ান্ডার ঘটনা ঘটত না। যদি আমাদের উপর গণহত্যা চালানোদের বিচার পাকিস্তানে হত, তবে বেলুচিস্তান আজ যা ঘটছে, তা ঘটত না।”

“যদি তোমরা তোমাদের সন্তানদের শিক্ষা না দাও যে কোনটা ভুল, আর কোনটা সঠিক, কোনটি গণহত্যা, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মে আবারও হিটলার জন্ম নিতে পারে,” বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেন নুজহাত।

লেইক শোর হোটেলের এই অনুষ্ঠানে যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, স্পেনের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।

তাদের সামনে দাঁড়িয়ে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানান শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদও।

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়ে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল, ধর্ষণ করেছিল ৩ লাখের বেশি নারীকে। হাজার হাজার বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল সৈন্যরা।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের একাত্তরের বন্ধু জুলিয়ান ফ্রান্সিস সেই সময়ের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে বলেন, এখনও দুঃস্বপ্নের ঘোরে চিৎকার করে ওঠে তিনি।

জুলিয়ান ফ্রান্সিস

অক্সফামের হয়ে তখন শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নেওয়া যুক্তরাজ্যের নাগরিক ফ্রান্সিস পরে বাংলাদেশেই থেকে যান; বাংলাদেশও তাকে আপন করে নিয়েছে নাগরিকত্ব দিয়ে।

পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখনও মাঝেমাঝে দুঃস্বপ্নে আমার ঘুম ভেঙে যায়, আমি চিৎকার করে উঠি। আমি দেখি কর্দমাক্ত নেই শরণার্থী শিবির, আর আমার বাহুতে একটি শিশুর লাশ।”

ফ্রান্সিস বলেন, “তখন যশোরের এক ইতালিয়ান যাজক আমাকে তখন বলেছিলেন, ২৫ মার্চের পরের ১০ দিনে শুধু যশোরেই ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।”

গণহত্যার এই সাক্ষী স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরও তৎপর হওয়ার আহ্বান জানান।

এজন্য তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দিয়ে ফ্রান্সিস সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্য তুলে ধরে বলেন, ২০টি জেলায় ৪ হাজার ১৮০টি স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। আর এই ২০ জেলার ১০টিতেই ৬৯৫টি হত্যাকাণ্ডস্থল, ৯২টি নির্যাতন কেন্দ্র, ৩৫১টি গণকবর চিহ্নিত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রদূত মো, জমিরের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ, বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বক্তব্য রাখেন। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাহ আলী ফরহাদ।

বিচারপতি মানিক বলেন, বিশ্ববাসী যদি একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে এই ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটার শঙ্কা থেকে যাবে। এক্ষেত্রে দেরি না করার আহ্বান জানান তিনি।

অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত রয়েছে।

অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার এই স্বীকৃতি এখনও না পাওয়ার জন্য বাংলাদেশে অন্য দলগুলোর সরকারের সময়ে ভিন্ন নীতি অনুসরণ করাকে দায়ী করেন।

২৫ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের সমর্থন প্রত্যাশা করেন তিনি।

কালরাত স্মরণে সোমবার রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আলোর মিছিলে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি।

একাত্তরে যে স্থান থেকে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠান থেকেও ২৫ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানানো হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষক সমিতি কালরাত স্মরণে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভার আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “বিশ্বের যে কোনো গণহত্যার চেয়ে ২৫ মার্চ কালরাতের গণহত্যা ছিল ভয়াবহ ও জঘন্যতম। এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দরকার। আমরা এর বিচার যেমনি চাই, তেমনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও চাই।”

শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাকসুদ কামাল বলেন, “ইউরোপে হলোকাস্টে ৬ বছরে যেখানে ৬০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ৯ মাসে নিহত হয়েছে ৩০ লাখ মানুষ।

“আমরা এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই। বিশ্বের সব সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরোধ, শহীদদের পরিবারের প্রতি সম্মাননা হিসাবে যেন এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।”

এদিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি রাত ৯টায় কালরাতের বিভীষিকার স্মরণে ব্ল্যাক আউট কর্মসূচি পালন করে। এক মিনিট পর মোমবাতি ও মশাল প্রজ্জলন করে মিছিল হয়।

ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু,  অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনসহ বিভিন্ন সংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বক্তব্য রাখেন।