গোবিন্দগঞ্জের ৯ রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন চূড়ান্ত

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ৯ রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2019, 02:57 PM
Updated : 25 March 2019, 03:13 PM

প্রসিকিউশনে জমা দিতে সাক্ষীদের জবানবন্দি ও জব্দ তালিকাসহ তিনটি ভলিউমে ১৮১ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে বলে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

ধানমণ্ডিতে তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান ও জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরতে তাদের সঙ্গে ছিলেন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিনুর রশিদ।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা, লুণ্ঠন,ধর্ষণের মতো ছয়টি অপরাধে চারটি অভিযোগ আনা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।

২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি তদন্ত শুরুর পর এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছে তা শেষ করতে। তদন্তকালে মোট ২৯ জনের জবানবন্দি নিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।

আসামিরা

গোবিন্দগঞ্জের শ্রীমুখ গ্রামের মো. মোফাজ্জল হক প্রধান ওরফে মোফা (৮২), একই উপজেলার নাসিরাবাদ কলোনির মো. আব্দুল করিম (৬৩), মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন ওরফে সরফ উদ্দিন খান ওরফে সাইফ উদ্দিন (৬৪), মো. সামছুল ইসলাম খান (৬৪), হামিদপুর গ্রামের সেকেন্দার আলী (৬৬), মালেকাবাদ গ্রামের মো. ইসমাইল হোসেন (৭০), হরিপুর গ্রামের মো. আকরাম প্রধান (৬৮), পুনতাইড় আগপাড়ার (পূর্বপাড়া) মো. হাফিজার রহমান (৬৪) ও বামন হাজরা গ্রামের মো. আব্দুল মান্নান (৬৪)। তাদের মধ্যে শরীফ উদ্দিন, সামছুল ইসলাম খান ও আব্দুল মান্নান পলাতক।

আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক বলেন, “মোফাজ্জল ওরফে মোফা মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের নেতা হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং থানার রাজাকার কমান্ডার হন। সর্বশেষ এই আসামি বিএনপিতে সক্রিয় ছিলেন।”

আব্দুল করিমও জামায়াতের কর্মী হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন বলে তদন্ত সংস্থা জানায়। সর্বশেষ জাতীয় পার্টিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি।

তদন্ত সংস্থা জানায়, শরীফ উদ্দিন, সামছুল ইসলাম, সেকেন্দার আলী, ইসমাইল হোসেন, আকরাম প্রধান, হাফিজার রহমান ও আব্দুল মান্নান জামায়াতের কর্মী হিসেবে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। সর্বশেষ তারা জামায়াতেই সক্রিয় ছিলেন।

তদন্ত কর্মকর্তা আমিনুর বলেন, ১৯৭১ সালের ১০ মে থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসামিরা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানার কাটাবাড়ী ইউনিয়নের ১ নং কাটাবাড়ী, ৭ নং কাটাবাড়ী, মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের শ্রীপতিপুর ও বালুয়া গ্রামে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করে।

চার অভিযোগ

প্রথম অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১০ মে আসামিরা কাটাবাড়ী ইউনিয়নের ৭নং কাটাবাড়ী গ্রামের জিয়া মন্ডল, মনা মন্ডল ও ওমেছ মন্ডলকে আটকের পর নির্যাতনের এক পর্যায়ে জবাই করে হত্যা করে এবং বাড়িঘরে লুটতরাজ চালায়। এরপর জিয়া মন্ডলের ছেলে আব্দুর রশীদ ও আব্দুল জোব্বার এবং কাঠালবাড়ী উত্তরপাড়ার মো. আজিজার রহমানকে আটকের পর নির্যাতন করে।

দ্বিতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ২২ জুলাই আসামিরা গাইবান্ধা জেলার বালুয়া গ্রামের মো. ইউনুস আলী আকন্দের বাড়িতে গিয়ে আকন্দের স্ত্রীসহ দুজনকে ধর্ষণ করে।

তৃতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ৩ অগাস্ট রাতে আসামিরা গোবিন্দগঞ্জের শ্রীপতিপুর গ্রামের আব্দুল কাদের সরকার, আব্দুস সোবহান আকন্দ ও এমাদ উদ্দিন আকন্দকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, পরে তাদের হত্যা করে। আসামিরা এসময় শ্রীপতিপুর গ্রামের একজনকে ধর্ষণও করে।

চতুর্থ অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর আসামিরা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের ১ নং কাটাবাড়ী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন ওরফে দুলাল, মুক্তিযোদ্ধা শাহজালাল মিয়া ওরফে ঝালু মিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে তাদের হত্যা করা হয়। তার আগে আসামিরা তাদের বাড়িঘর লুট করে।

এই পর্যন্ত ১৮০ জনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন

২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এই পর্যন্ত ৬৯টি প্রতিবেদনে ১৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংস্থা।

সানাউল হক বলেন, আরও ৪৯ আসামির বিরুদ্ধে ২৪টি মামলা এখনও তদন্তাধীন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ৯ বছরে যুদ্ধাপরাধ মামলার দণ্ডিত আসামিদের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। দণ্ডিত ৩৪ আসামি এখনও পলাতক।”

ট্রাইব্যুনালে এই পর্যন্ত ৩৫ মামলায় ৮৭ যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। ২৮টি মামলা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। আর আপিল বিভাগে বিচারাধীন ২৩টি মামলা।

২০১০ সালের ২৫ মার্চ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।