যুদ্ধাপরাধের মামলা নিষ্পত্তিতে আপিল বিভাগে বিশেষ বেঞ্চ চায় তদন্ত সংস্থা 

প্রায় তিন বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধের কোনো মামলার চূড়ান্ত নিস্পত্তি না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার শীর্ষ দুই কর্মকর্তা।

নিজস্ব প্রতিবেদকমেহেদী হাসান পিয়াসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2019, 02:34 PM
Updated : 25 March 2019, 03:12 PM

এই অবস্থা থেকে উত্তরণে আপিল বিভাগের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে একটি বিশেষ বেঞ্চ গঠনের সুপারিশ করেছেন তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান ও জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনাল ও তদন্ত সংস্থা গঠনের দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গত ৯ বছরের অর্জন, সাফল্য, সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির ধীর গতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তারা।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল বিভাগে যেতে পারে, সেখানে হয় মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি।

যুদ্ধাপরাধের মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি শেষে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, মো. কামরুজ্জামান, মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি শেষে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রয়েছেন কারাগারে।

সোমবার একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরতে ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ধানমণ্ডিতে তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে হান্নান খান বলেন, “মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষী, ভিকটিম, বিচারপ্রার্থী ও দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় নিয়ে যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।

“যে সমস্ত মামলা সুপ্রিম কোর্টে আপিলে পেন্ডিং আছে সেসব মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ভিকটিম, অত্যাচারিত, নির্যাতিত বা বিচার প্রার্থীদের এক ধরনের অতৃপ্তি আছে, আমাদেরও এক ধরনের অস্বস্তি আছে এ নিয়ে।”

তিনি বলেন, “আপিলে মামলা নিস্পত্তির ক্ষেত্রে একটা সুযোগ আছে। সেটা নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের উপর। যেটা অন্যান্য আন্তর্জাতিক আদালতেও হয়ে থাকে। তা হল এসব (যুদ্ধাপরাধ মামলা) মামলা নিস্পত্তির জন্য একটি বা একাধিক আপিল আদালতও থাকে।  

“এখানে সরকার ও নীতি নির্ধারক যারা আছেন, তাদের প্রতি আমার পরামর্শ হবে, আমাদের জন্য তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে একটি বেঞ্চ গঠন করে দেওয়া হোক এ মামলাগুলো নিস্পত্তির জন্য।”

এখানেই চলছে যুদ্ধাপরাধের বিচার

তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক বলেন, “এক সময় ট্রাইব্যুনালে বিচার সম্পন্ন হওয়ার প্রায় সাথে সাথে আপিল বিভাগেও সমাধান হয়ে যেতে দেখেছি। এখন হয়ত আপিল বিভাগে কাজের ওভার বার্ডেন বা সামথিং। আমরা তো আর জিজ্ঞেস করতে পারি না তাদের। কিন্তু গত প্রায় তিন বছর ধরে আপিল বিভাগে কোনো মামলা চূড়ান্ত পরিণতিতে যায়নি।”

এ নিয়ে সাক্ষী ও বিচারপ্রার্থীরা প্রশ্ন তুলে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের তো আর ক্ষমতা নাই তাদের গিয়ে গিয়ারআপ করার। তবে এগুলো আমাদের ব্যর্থতা নয়, সীমাবদ্ধতা।”

আপিলে মামলা নিস্পত্তির বিষয়ে সানাউল বলেন, “এসকল মামলার বাদী হলেন চিফ প্রসিকিউটর। আবার চিফ প্রসিকিউটর অ্যাটর্নি জেনারেলের মর্যাদার। আমারা মামলাটা ছেড়ে দিই চিফ প্রসিকিউটরের হাতে। এরপর সহযোগিতা করতে থাকি যতদূর পর্যন্ত মামলা যায়।

“আমাদের চিন্তা হলো, যদি চিফ প্রসিকিউটর এই আপিলগুলোকে আপিল বিভাগে প্রসিকিউট করেন, তাহলে এ সমস্যার সমাধানের পথ তৈরি হত।”

এপ্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “অ্যাটর্নি জেনারেল ভারাক্রান্ত থাকেন অতিরিক্ত কাজের চাপে। তিনি তো রাষ্ট্রের প্রধান ল অফিসার। তাই অ্যাটর্নি জেনারেলের সহযোগিতা নিয়ে চিফ প্রসিকিউটর মামলাগুলো আপিলে প্রসিকিউট করতে পারেন। এতে আইনগত কোনো বাধা থাকার কথা না।”

সানাউল হক (ফাইল ছবি)

তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল নিজেদের কাজের মূল্যায়ন করে বলেন, “গত ৯ বছরে ট্রাইব্যুনালে যা হয়েছে তা প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থা ও ট্রাইব্যুনালের সম্মিলিত ফল।

“এসব মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা কঠিন ছিল। এত পুরনো মামলা আর কোনো দেশে এত সাকসেসফুললি প্রসিকিউট করা হয়েছে, এমন নজির নেই। আমরা বিচারই শুরু করেছি প্রায় চার দশক পরে। ততদিনে আসামিদের বয়স হয়ে গেছে। মানুষের স্মৃতি বিভ্রমও ঘটেছে।”

সানাউল বলেন, “সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করা। দেশের একটি বিরাট সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল, তার পেছনে আরও রাজনৈতিক দল একেবারে মরণপণ এই বিচারের বিরুদ্ধে চেষ্টা করেছে দেশে থেকে দেশের বাইরে থেকেও।

“আন্তর্জাতিকভাবে এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। দেশে সহিংসতা ঘটানো হয়েছে। তারপরেও আমাদের সাক্ষীরা সাহস দেখিয়েছে। সবচেয়ে সাহসী তারাই। যারা মুক্তিযোদ্ধা তারা তো অবশ্যই সাহসী। কিন্তু যেসব সাক্ষীরা মুক্তিযোদ্ধা নন, তারাও মুক্তিযোদ্ধার মতোই সাহস দেখিয়েছেন এই সময়ে এসে, এই প্রতিকূল অবস্থায়। এটা এদেশের স্বাধীনতাকামী, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মানুষের বিশাল অর্জন। এটাই আমাদের সফলতা।”

কাজের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে এ তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “আর সীমাবদ্ধতা বলতে, যে গতিতে বিচারগুলো হওয়া দরকার তা এখন হচ্ছে না। কারণ এ বিচারের এক ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে। ফৌজদারী মামলা অনেকদিন ধরে চলতে পারে।

“কিন্তু কোনো সাক্ষী যদি মারা যায়, আসামি যদি মারা যায়, বিচার প্রার্থীরা যদি মারা যায়, তারা যদি বিচার না দেখতে পারে, তাহলে এটা এক ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই থেকে যাচ্ছে।”

৯ বছরে ৩৫ মামলায় ৮৭ যুদ্ধাপরাধীর সাজা

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত ৯ বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩৫ মামলায় ৮৭ যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। ২৮টি মামলা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। আর আপিল বিভাগে বিচারাধীন ২৩টি মামলা।

সোমবার গোবিন্দগঞ্জের ৯ রাজাকারের বিরুদ্ধে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ১৮০ আসামির বিরুদ্ধে ৬৯টি তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।

আরও ৪৯ আসামির বিরুদ্ধে ২৪টি মামলা তদন্তাধীন বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ৯ বছরে যুদ্ধাপরাধ মামলার দণ্ডিত আসামিদের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। দণ্ডিত ৩৪ আসামি এখনও পলাতক। আশা করি আপিলে বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিস্পত্তি হবে।”

২০১০ সালের ২৫ মার্চ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।