‘সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনয়ন এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি’র ওই খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।”
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, আগামী ৪ এপ্রিলের আগেই এই সুপারিশমালা মন্ত্রণালয়ে জমা দেবেন তারা।
গতবছর জুলাই মাসে দুই কলেজশিক্ষার্থীর মৃত্যুর সারা দেশে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে পরিবহন খাতের বিভিন্ন স্তরে বিশৃঙ্খলার বিষয়গুলো নতুন করে সামনে চলে আসে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সে সময় সড়ক দুর্ঘটনাকে সরকারের ‘সবচেয়ে বড় দুর্ভাবনার বিষয়’ হিসেবে বর্ণনা করেন। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খোদ সরকারপ্রধান মন্ত্রিসভার বৈঠকে বেশ কিছু নির্দেশনা দেন।
এর ধারাবাহিকতায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পরিবহন মালিক, শ্রমিক, পুলিশ, গবেষক ও বিআরটিএসহ বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে ২২ সদস্যের এই কমিটি করা হয়।
এর মধ্যে পুলিশ দফায় দফায় ট্রাফিক সপ্তাহ পালনসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালালেও সড়কে মৃত্যু থেমে থাকেনি। গত ১৯ মার্চ ঢাকার প্রগতি সরণিতে বাস চাপায় এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর আবারও রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা।
এই ১১১ সুপারিশের বেশিরভাগই এর আগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কমিটির প্রতিবেদনে এসেছে। সড়কে নিরাপত্তা চেয়ে রাস্তায় নামা শিক্ষার্থীদের দাবির কিছু বিষয়ও এর মধ্যে রয়েছে।
উচ্চ পর্যায়ের এই কমিটি মনে করছে, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ প্রণয়নে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল এর বাস্তবায়নের সময়সীমা। এ কারণে কমিটির সুপারিশগুলোকে বাস্তবায়নের মেয়াদের ভিত্তিতে চার ভাগে সাজানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
এর মধ্যে আশু করনীয় সুপারিশগুলো এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে, স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনাগুলো ২০২১ সালের মধ্যে এবং দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশগুলো ২০২৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা উচিৎ বলে কমিটি মনে করছে। আর একটি ভাগের সুপারিশগুলো চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে থাকবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে, সব সংস্থা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবে এবং সরকার পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করবে ধরে নিয়েই এ সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর ব্যত্যয় ঘটলে সুপারিশ বাস্তবায়নে বেশি সময় লাগবে, আর এ কারণেই সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রসঙ্গ টেনেছে কমিটি।
অতীতের বহু কমিটির সুপারিশ যেখানে কাগজের বাইরে বের হতে পারেনি, সেখানে এসব প্রস্তাবের বাস্তবায়ন হবে কি না- এমন প্রশ্নে শাজাহান খান বলেন, “আগেও সুপারিশ দিত। সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব হয়ত দেওয়া হত মন্ত্রণালয়কে, বিআরটিএ বা মালিক-শ্রমিক কমিটিকে। এবার আমরা সেভাবে সুপারিশ দেব না। এই সুপারিশটাকে যখন সরকার গ্রহণ করবে, এরপর সরকার এক বা একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করে দেবে। এই টাস্কফোর্সের দায়িত্ব হবে অ্যাকশনে যাওয়া। এই বিষয়টায় আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমরা অবাস্তব কিছু এখানে রাখিনি। সবগুলো সুপারিশ কমবেশি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এখানে অসম্ভবের কিছু নাই।”
সড়ক নিরাপত্তা ইস্যুতে বরাবর মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ নেওয়া শাজাহান খানকে এই কমিটির প্রধান করায় সমালোচনা এসেছে সরকারের ভেতর থেকেই। এছাড়া সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনকারীরাও শাজাহান খানকে কমিটিতে রাখায় ক্ষোভ জানিয়েছেন।
এ কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ, যিনি জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবং বর্তমান সংসদের বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী, কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন সদস্য হিসেবে আছেন এই কমিটিতে।
যা আছে সুপারিশে >> অবিলম্বে সড়ক পারিবহন আইনের বিধিমালা জারি >> সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি স্কুলের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা >> সড়ক উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পের ৫ শতাংশ অর্থ সড়ক নিরাপত্তার জন্য রাখা >> জেলা ও উপজেলা সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ক্ষমতা বৃদ্ধি >> চালক প্রশিক্ষণে সরকারি খরচে ইন্সট্রাক্টর তৈরির কার্যক্রম নেওয়া >> ইন্সট্রাক্টর নিয়োগে সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্তদের অগ্রাধিকার দেওয়া >> চাকরিতে নারী চালকদের অগ্রাধিকার দেওয়া >> ট্রাফিক পুলিশের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ >> রাজধানী থেকে রিকশা তুলে দেওয়া >> রাইড শেয়ারিং কোম্পানির জন্য গাড়ির সংখ্যা বেঁধে দেওয়া >> কেবল লাইসেন্সধারী চালকদের মোটরসাইকেল বিক্রি করা >> দৈনিক ভিত্তিতে চালক নিয়োগ না দেওয়া, চালকদের সুনির্দিষ্ট মজুরি নির্ধারণ >> রাস্তায় প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজি প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন >> সড়কে ডিজিটাল মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা
|
সচেতনতা
কমিটির খসড়া প্রতিবেদনের প্রথম সুপারিশটি জনসচেতনতা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর।
তাতে বলা হয়েছে, সচেতনতা বাড়াতে সড়কে আচরণবিধি ও সচেতনতামূলক নাটিকা গণমাধ্যমে বিনামূল্যে প্রচার বাধ্যতামূলক করতে হবে। এগুলো দিতে হবে বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড এবং বাসের টিকেটেও।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ট্রাফিক আইন ও সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে ধারণা দিতে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যক্রমে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
প্রশিক্ষণ
প্রশিক্ষিত লোক দিয়ে দক্ষ চালক তৈরির জন্য দেশের সব জেলায় মানসম্মত ড্রাইভিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে বলছে কমিটি।
এ বিষয়টি বিআরটিএর উদ্যোগে বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ড্রাইভিং স্কুল প্রতিষ্ঠায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কম সুদে দীর্ঘমেয়াদী ব্যাংক ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে খসড়া প্রতিবেদনে।
প্রশিক্ষক হিসেবে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্তদের অগ্রাধিকার দিয়ে ২০২০ সালের মধ্যে এক হাজার প্রশিক্ষক তৈরির ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কমিটি।
নারী গাড়ি চালক ‘অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকি নেয়’- এমন পর্যবেক্ষণ দিয়ে এ পেশায় তাদেরকে আলাদা সুযোগ দেওয়া, চাকরিতে নারী চালকদের অগ্রাধিকার দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে।
খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাফিক পুলিশকে সড়ক নিরাপত্তা, দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ ও দুর্ঘটনার তদন্ত ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উপর উন্নত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
অবকাঠামো
দেশের সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা নিয়েও বেশকিছু সুপারিশ রয়েছে কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে।
শহরের ফুটপাত দখলমুক্ত করা, যেসব জায়গায় ফুটপাত নেই সেখানে ফুটপাত নির্মাণ, স্কুল কলেজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সামনে উঁচু করে জেব্রাক্রসিং নির্মাণ এবং সড়ক বিভাজকে পথচারীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা দেওয়ার সুপারিশ রয়েছে সেখানে।
তবে সড়কে কোনো ধরনের গতিরোধক না দেওয়া, মহাসড়কের দুই পাশে ২০ মিটার জায়গায় কোনো ধরনের স্থাপনা না রাখা এবং দোকান নির্মাণ করা হলে সেক্ষেত্রে দোকানের মুখ মহাসড়কের উল্টো দিকে রাখতে বলা হয়েছে সুপারিশে।
এছাড়া রাস্তায় কোনো ধরনের ম্যানহোল ও ডাস্টবিন না রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ম্যানহোল সরানো না গেলে সড়কের সমতলে রাখতে বলা হয়েছে।
কমিটি বলছে, রাস্তার সংযোগস্থলগুলোর ১৫০ ফুট পর্যন্ত কোনো ধরনের গাছপালা থাকতে পারবে না। নতুন যে কোনো রাস্তা নির্মাণের সময় সড়ক নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে কি না তা বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
কিছু কিছু রাস্তার সংযোগস্থল উঁচু করা এবং নতুন মহাসড়ক নির্মাণের সময় সার্ভিস রোডের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছে কমিটি।
খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর ট্রমা সেন্টার ও ফায়ার স্টেশন স্থাপন করতে হবে। দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়কে ডিজিটাল মনিটরিংয়ের জন্য সিসিটিভি বা স্পিড রাডার গান বা গাড়ির গতি ও ছবি সংরক্ষণ উপযোগী যন্ত্র স্থাপন করতে হবে।
যানবাহনের জন্য সুপারিশ
মহাসড়কে নসিমন জাতীয় যানবাহন নিষিদ্ধ করা এবং সাইকেলের জন্য আলাদা লেইন তৈরি করে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে খসড়া প্রতিবেদনে।
শহরের ভেতর চলাচলকারী যানবাহনের শৃঙ্খলা আনা এবং যানবাহনের ধরন কেমন হবে সে বিষয়েও কিছু প্রস্তাব এসেছে সেখানে।
এর মধ্যে শহরে বাসের মধ্যে প্রতিযোগিতা দূর করতে ফ্র্যাঞ্চাইজি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। গাড়িতে মোবাইল ট্র্যাকার স্থাপনেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কমিটি বলছে, ঢাকার সড়ক থেকে পর্যায়ক্রমে রিকশা সরিয়ে ফেলতে হবে। সেজন্য বিশদ পরিকল্পনা নিতে হবে।
রাইড শেয়ারিং কোম্পানিতে কত গাড়ি চলতে পারবে তার সীমা নির্ধারণ এবং মোটরসাইকেল বিক্রির আগে চালকের লাইসেন্স আছে কি না তা নিশ্চিত করতে বলছে কমিটি।
চালক
কমিটি বলছে, চলন্ত অবস্থায় চালকের মোবাইলে কথা বলা বা হেডফোনে গান শোনা বন্ধে কঠোর হতে হবে। গণপরিবহনের নির্ধারিত জায়গায় চালক ও হেলপারের ছবি, লাইসেন্স নম্বর ও ফোন নম্বর দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূরপাল্লার বাস ও ট্রাকে প্রতি ৫ ঘণ্টা পর চালকদের বিশ্রাম এবং ৮ ঘণ্টা পর একজন বিকল্প চালকের ব্যবস্থা করতে হবে।
দৈনিক ভিত্তিতে চালক নিয়োগ না দিয়ে চালকদের সুনির্দিষ্ট মজুরি নির্ধারণের সুপারিশ এসেছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, প্রয়োজনে চালকদের জন্য নির্ধারিত পোশাকের ব্যবস্থা করার কথা ভাবতে হবে।
রোড সেফটি অথরিটি
সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে রোড সেফটি অথরিটি গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে খসড়া প্রতিবেদনে।
এই কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে বাস্তব পরিকল্পনা নেবে এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাজের তদারকি করবে।
সড়ক, নৌ ও রেল এ তিনটি মাধ্যমের বহুমুখী সমন্বিত পরিবহন নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়ন করার সুপারিশ এসেছে প্রতিবেদনে। গবেষণার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
কমিটি বলছে, সড়কের উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পের ৫ শতাংশ অর্থ সড়ক নিরাপত্তার জন্য রাখতে হবে। সড়ক সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে তাদের বার্ষিক মুনাফার ১ থেকে ২ শতাংশ ওই তহবিলে জমা দিতে হবে।
পাশাপাশি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ বিমার টাকা পাওয়া সহজ করার কথাও বলেছে শাজাহান খানের কমিটি