অনেক সাধের ফ্ল্যাটে উঠে এখন তারা বিপদে

নির্ধারিত মেয়াদের পর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি উত্তরায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের সব কাজ। অনেকটা হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত না করেই ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রাহকদের।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2019, 06:35 AM
Updated : 17 March 2019, 10:56 AM

এ অবস্থায় অনেকেই তাদের স্বপ্নের ফ্ল্যাটে উঠে বিপাকে পড়েছেন। অনেকে চাবি বুঝে পেলেও ভোগান্তির শঙ্কায় ফ্ল্যাটে উঠতে সাহস পাচ্ছেন না।   

ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়া কয়েকজন অভিযোগ করেছেন, রাজউকের চাপে তারা ফ্ল্যাটে উঠতে বাধ্য হয়েছেন। আর রাজউক অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, বরাদ্দপ্রাপ্তরাই জোর করে ফ্ল্যাটে উঠেছেন।

২০০০ সালের ২৫ এপ্রিল প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয়। ২০১০ সালের ২১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ধরা হয় ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত। এ প্রকল্পে ২৪০টি ১৬ তলা ভবনে ২০ হাজার ১৬০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করার কথা।

রাজউক জানিয়েছে, এ পর্যন্ত প্রথম ধাপে ২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ৮৪০টি, দ্বিতীয় ধাপে ২০১৮ সালের ৭ জানুয়ারি দুই হাজার ৬২১টি এবং তৃতীয় ধাপে এ বছরের ৩ মার্চ ৭৯৭টি ফ্ল্যাটের নম্বর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে ৯২২টি ফ্ল্যাটের চাবি মালিকদের হস্তান্তর করেছে রাজউক। এখন পর্যন্ত ৬০টির মতো পরিবার ফ্ল্যাটে উঠেছেন।

দুর্ভোগের শেষ নেই

প্রকল্পে যারা ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন কিন্তু চাবি বুঝে পাননি আর যারা ফ্ল্যাটে উঠেছেন, সবাই আছেন বিপদে।

উত্তরায় রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের এসব ভবনের ফ্ল্যাট নির্ধারিত সময়ে না পেয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন বরাদ্দপ্রাপ্তরা; গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনেক প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে চললেও ভৌত কাজই শুরু হয়নি।

যারা ফ্ল্যাটে উঠেছেন তাদের ভাষ্য, প্রকল্প এলাকার সীমানা প্রাচীর নির্মাণ হয়নি, নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পয়ো ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি অনেক ভবনে, ফলে লিফট চলে না। এলপি গ্যাসের ট্যাংক বসানো হলেও তাতে গ্যাস দেওয়া হয়নি।

কোনো ভবনেই মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজারসহ নাগরিক সব সুবিধা এখনও নাগালের বাইরে।

প্রকল্পে একটি ফ্ল্যাটের বরাদ্দ পাওয়া সাবেক জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ নাসিরুজ্জামান বলেন, “চুক্তি অনুযায়ী ২০১৬ সালে আমাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। সে হিসেবেই আমরা টাকা জমা দেই। আশা করেছিলাম ২০১৬ সালেই আমরা বাসা পাব। কিন্তু তাদের বিভিন্ন সমস্যার কারণে তা ঠিকমতো করতে পারেনি। এখন শুনছি এটা নাকি ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে, তাদের কাজ নাকি শেষ হচ্ছে না।

“আমরা যারা বাইরে বাসা নিয়ে আছি তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, ভাড়াও গুণতে হচ্ছে আবার আমরা বাসায়ও উঠতে পারছি না। ফ্ল্যাটগুলো বাইরে থেকে ঝকঝকা দেখা গেলেও আমরা যারা সাফারার তারা বুঝতেছি যে কি অবস্থা। ভেতরে নানাবিধ সমস্যা। যে কারণে লোকজন উঠতে পারছে না। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ, বাজার নাই। অন্ধকার, নিরাপত্তা নাই, যোগাযোগ ব্যবস্থা নাই এভাবেই চলছে। এই কথাগুলো বলারই সুযোগই পাচ্ছি না।”

আরেক ফ্ল্যাটগ্রহীতা সরকারি কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল অভিযোগ করেন, ২০১২ সালে বরাদ্দ পেয়ে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে কিস্তির টাকা দেওয়া শুরু করেছেন। ২০১৬ সালে টাকা দেওয়া শেষ হলেও এখনও তিনি ফ্ল্যাটে উঠতে পারেননি।

“চারটি কিস্তি আর ডাউনপেমেন্ট মিলে ৩৫ লাখ টাকা দিয়ে রেখেছি দুই বছরের ওপর হয়ে গেল। কিন্তু আমাকে বাসা ভাড়া দিয়ে বাইরে থাকতে হচ্ছে। এবার ফ্ল্যাটের চাবি পেয়েছি কিন্তু সেখানে আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে উঠব কিভাবে? নাগরিক সুবিধা কিছুই নেই।”

লটারিতে চাবি পেয়ে পরিবার নিয়ে ফ্ল্যাটে উঠে ভোগান্তিতে পড়া একজন মোশাররফ হোসেন রানা।

তার অভিযোগ, কোনো নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত না হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন তারা। তিনি যে ভবনে বরাদ্দ পেয়েছেন সেখানে ৮৪টি ফ্ল্যাট প্রস্তুত হলেও ১৪টি পরিবার উঠেছে। রাতে পুরো এলাকায় ভুতুড়ে পরিস্থিতি তৈরি হয়।

“বাউন্ডারি ওয়াল করেনি বলে নিরাপত্তাহীনতায় থাকি। মোবাইলের নেটওয়ার্ক না থাকায় এখানে ঢোকার পর কেউ আর ফোন করে পায় না। দোকানপাট-বাজারঘাট তো নাই। একটা ডিম কিনতে হলেও উত্তরা যেতে হবে, সেটা অবশ্যই সন্ধ্যার আগে। অনেকে উঠে আবার চলেও যাচ্ছে।”

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বরাদ্দ পাওয়া একজন অভিযোগ করেন, ২০১৮ সালে রাজউক ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তরের পরই ফ্ল্যাটে ওঠার জন্য চাপ দিতে থাকে।

প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা না দিয়ে ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর রাজউকের প্রহসন বলে মন্তব্য করেন আরেক বরাদ্দপ্রাপ্ত মাসুম বিল্লাহ। তিনি বলেন, এসটিপি, বিদ্যুতের সংযোগ, গ্যাস সংযোগ না দিয়েই ফ্ল্যাট রেডি বলে আইডি দেওয়া হয়ে গেছে।

“এইটা তো প্রহসনই। গ্যাস দেওয়ার কথা, লাইন আছে কিন্তু তাতে গ্যাস নাই। তাহলে ওই লোকটা এইখানে গিয়ে বসবাস করবে কিভাবে?”

প্রকল্পের হাসনাহেনা ভবনের বাসিন্দা নূর হোসাইন সিদ্দিকী পলাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ফ্ল্যাটগুলোকে বসবাসের অযোগ্য বলব না। তবে আমরা নানা সমস্যায় আছি। অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসবাস করছি।

“কোনো যাতায়াত ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। ১৬ ও ১৭ নম্বর সেক্টরে সন্ধ্যার পরে কোনো পুলিশ থাকে না বলে নিরাপত্তাহীনতায় কেউ সেদিকে যায় না। নিরাপত্তাটা নিয়ে আমরা বেশি উদ্বিগ্ন, এখনো সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়নি।”

রাজউকের বক্তব্য

ফ্ল্যাটে উঠতে বরাদ্দপ্রাপ্তদের ওপর জোর খাটানোর অভিযোগের জবাবে উল্টো কথা বলেছেন রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন।

বরাদ্দপ্রাপ্তরাই জোর করে ফ্ল্যাটে উঠেছেন দাবি করেন তিনি বলেন, “রাজউক কাউকে চাপ দেয়নি। অসমাপ্ত কাজ খুব দ্রুতই শেষ করা হবে।

“বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ শেষ হতে মাস তিনেক লাগবে। এই মার্চের মধ্যে শতভাগ ফ্ল্যাটে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে।”

তবে চাবি পাওয়া সব বাসিন্দা ফ্ল্যাটে না উঠলে গ্যাস সরবরাহ করা কঠিন বলে জানান তিনি।

“এলপি গ্যাসের ট্যাংক থেকে পাইপ দিয়ে বাসায় গ্যাস নিতে হবে। এখন প্রতিটি ভবনের ৮৪টা ফ্ল্যাটের মধ্যে কোনোটাতে তিনটা, কোনোটাতে চারটা ফ্যামিলি উঠেছে। পর্যাপ্ত ব্যবহারকারী না থাকলে সেই ট্যাংকিতে গ্যাস দেওয়া যাবে না। লোডের একটা ব্যাপার আছে। এজন্য বসুন্ধরা নিজ দায়িত্বে এলপি গ্যাস পৌঁছে দিচ্ছে।”

নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়েছে বলে জানান আনোয়ারুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “রাজউকের তো কোনো নিরাপত্তাবাহিনী নেই। আমরা পুলিশকে চিঠি দিয়েছি টহল পাঠানোর জন্য। প্রয়োজনে একটা ক্যাম্প বানালে আমরা জায়গা দেব। আপদকালীন সময়ের জন্য আমরা কিছু আনসারের রিকুইজিশন দিয়েছি। এপ্রিলের এক তারিখের মধ্যে আনসার দায়িত্বপালন করা শুরু করবে।”