সেই সঙ্গে একটি আইসিইউ বা সিসিইউ ইউনিট তৈরির জন্য কত টাকা খরচ হয়, কী পরিমাণ লোকবল ও বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন, সে বিষয়েও প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
আগামী ২৪ এপ্রিলের মধ্যে স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকে হলফনামা আকারে এ প্রতিবেদন দিতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনায় নীতিমালা প্রণয়ন ও চিকিৎসা সেবার মূল্য তালিকা প্রদর্শনের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতি প্রতিবেদনের ওপর শুনানি করে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেয়।
‘দ্য মেডিক্যাল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশনস) অর্ডিন্যান্স-১৯৮২’ অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়নে আদালতের আদেশ কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, তার অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আদেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট।
সে অনুযায়ী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ৪ মার্চ অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করে। সেটিই বুধবার আদালতে উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। আর রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী বশির আহমেদ।
অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, আদালতের নির্দেশে গত ২৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর পরিচালক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক মালিক সমিতির মহাসচিব সদস্য হিসেবে আছেন ওই কমিটিতে।
এই কমিটি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনার জন্য খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছে।
আদালতের আদেশের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু সাংবাদিকদের বলেন, “নীতিমালা প্রণয়নে আদালতের আদেশ কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, তার অগ্রগতি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। অগ্রগতি প্রতিবেদনে একটি খসড়া নীতিমালা দিয়েছে মন্ত্রণালয়, সেটি উপস্থাপন করা হয়েছে।”
আদেশের আগে আদালত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজুর কাছে জানতে চায়, দেশে কতগুলো আইসিইউ ইউনিট আছে।
উত্তরে সাজু জানান, ৭২টি। তার মধ্যে ঢাকা মেডিকেলে সবচেয়ে বেশি, ৩০টি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ১০টি।
এ পর্যায়ে রিটকারী আইনজীবী বশির উল্লাহ দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে আইসিইউ-সিসিইউ স্থাপনের বিষয়ে আদেশ চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু তাতে আপত্তি জানান।
তিনি বলেন, একটি আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করতে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা লাগে। তাছাড়া পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত লোকবল, বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন। এ আদেশ দিলে তা বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব সেটাও বিবেচনা করতে হবে।
বিচারক তখন বলেন, “দেশ তো এখন আর গবিব না। চিকিৎসা সেবায়ও প্রভূত উন্নতি হয়েছে। দেবী শেঠী যেখানে আমাদের চিকিৎসা সেবার প্রসংশা করেছেন… এটা কিন্তু ভালো দিক। তবে সে অনুযায়ী কিন্তু আমাদের চিকিৎসা সেবার উন্নতি দৃশ্যমান হচ্ছে না। আপনি টাকার চিন্তা করছেন কেন?”
এরপর আদালত আদেশ দেয়।
খসড়া নীতিমালা
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির করা খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে-
# কোনো উদ্যোক্তা পরিচালক হাসপাতাল ও ক্লিনিক করার অনুমোদন পাওয়ার আগে কার্যক্রম শুরু করতে পারবে না।
# ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন তহবিল ও ব্যাংক হিসাব’ শিরোনামের ধারায় বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন তথা প্রতিষ্ঠানটি পূর্ণাঙ্গভাবে স্থাপন এবং অব্যাহতভাবে সেবা চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠান স্থাপন শেষে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাবে প্রতিষ্ঠান ভেদে অর্থের চলমান স্থিতি থাকতে হবে।
# খসড়া নীতিমালার ৩ ধারায় বলা হয়েছে, আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানটি যেসব সেবা দেবে, তা আবেদনপত্রের সঙ্গে উল্লেখ করতে হবে। তবে আইসিইউ, সিসিইউ, ডায়ালাইসিস ও রক্ত সঞ্চালন সেবার জন্য আলাদাভাবে অনুমোদন নিতে হবে। এসব সেবার তালিকা প্রতিষ্ঠানের একটি দৃশ্যমান জায়গায় যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে এবং প্রদর্শন করতে হবে।
# ‘সেবার খরচ’ শিরোনামে ৪ ধারায় বলা হয়েছে, জনসাধারণকে রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান যে ফি বা মূল্য ধার্য করবে, তার তালিকা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের জন্য দেওয়া আবেদনপত্রে যুক্ত করতে হবে। গবিব রোগীদের সেবার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫ শতাংশ ছাড় বা রেয়াত দিতে হবে। মূল্য তালিকা দৃশ্যমান জায়গায় প্রদর্শন করতে হবে।
# ব্যবস্থাপনা কমিটি সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, হাসপাতাল পরিচালনার জন্য উদ্যোক্তাদের গঠনতন্ত্র বা মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন অনুযায়ী একটি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটি করতে হবে। কমিটিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের মনোনীত প্রতিনিধি, স্থানীয় জন প্রতিনিধি এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা থাকবেন। প্রতিটি কমিটি দুই বছরের জন্য গঠিত হবে। কমিটি প্রতি তিন মাস পর পর সভা করবে এবং সভার কার্যবিবরণী বা সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠাবে।
# বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের গৃহস্থালী ও মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র অথবা সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন অথবা পৌরসভা অথবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সম্পাদিত চুক্তিপত্র আবেদনপত্রের সাথে যুক্ত করতে হবে।
এছাড়া পরিদর্শন কমিটি, পরিদর্শন কমিটির কার্যপরিধি, প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা পরিবর্তন, মালিকানা পরিবর্তন, এক্রিডিটেশন বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়।
হিউম্যান রাইটস লইয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিং এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশের পক্ষে কোষাধ্যক্ষ মো. শাহ আলম গত বছরের জুলাইয়ে জনস্বার্থে এ রিট আবেদন করেন।
প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ২৪ জুলাই সকল বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাবেরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসা সংক্রান্ত পরীক্ষার মূল্য তালিকা এবং ফি (উন্মুক্ত স্থানে) পাবলিক প্লেসে প্রদর্শনের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
আদালতের ওই আদেশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে তা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
এছাড়া ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশনস) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’ অনুযায়ী নীতিমালা তৈরি এবং তা বাস্তবায়নের জন্য আদেশ পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করতে নির্দেশ দেয় আদালত।
এছাড়া চালু থাকা হাসপাতাল এবং ক্লিনিক ও ডায়গনিস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স অনুমোদন, তাদের সেবার বিষয় তদারকি এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশনস) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’ অনুসারে নীতিমালা তৈরির কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং সকল জেলা সদরের হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিউ) করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) স্থাপনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে আদালত।
স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।