যুদ্ধদিনের গল্প শুনালেন একাত্তরের বন্ধু কনেট দম্পতি

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়াতে ছুটে এসেছিলেন ভিনদেশি পল কনেট ও এলেন কনেট। এবার ঢাকায় এসে সেই স্মৃতি থেকে অকপট ইতিহাস মেলে ধরলেন দুজন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2019, 06:03 PM
Updated : 26 Feb 2019, 06:05 PM

মঙ্গলবার দুপুরে স্ত্রী এলেন কনেটকে নিয়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন পল। সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক এই ব্রিটিশ নাগরিকের পরিচয় দেওয়ার পর তারা নিজেদের ভাষ্যে তুলে ধরেন একাত্তরের গল্প।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরে প্রবাসে জনমত গঠনে বিভিন্ন ফোরাম গঠিত হলেও একেবারেই ভিনদেশিদের নিয়ে আলাদা একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করার কথা ভাবেন অধ্যাপক পল কনেট। সেই ভাবনা থেকে তিনি গঠন করেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’, এতে যোগ দেন এলেন কনেট।

ওই সময় পত্রিকা পিস’র সম্পাদক রজার মুডি তার নিজের অফিসেই ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর কার্যক্রম শুরুর অনুমতি দেন। দপ্তর পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে এই সংগঠনে যোগ দেন মারিয়েটো প্রকোপে, যিনি পেশায় ছিলেন শিক্ষক।

নিজের সংগঠন নিয়ে পল কনেট বলেন, “আমার কাছে মনে হয়েছিল, শুধু প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করলেই জনমত গঠন করা যাবে না। এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের।

“সে ভাবনা থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু। ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের কয়েকজন মানুষের সঙ্গেও পরিচয় হয়ে যায়।”

গণহত্যা প্রতিরোধ ও শরণার্থীদের সহযোগিতায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ একাত্তরের ১ অগাস্ট ট্রাফালগার স্কয়ারে জনসভা করে। সেদিন সেখানে ২০ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল বলে জানান পল।

ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের মন্ত্রিসভা বাংলাদেশকে সহজে যে স্বীকৃতি দিতে চায়নি, সে কথা উঠে আসে পলের বয়ানে।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে পাক বাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে কম নিন্দা, সমালোচনা হয়নি। এ ঘটনায় নিন্দা প্রস্তাব, বাংলাদেশকে সহযোগিতা করা নিয়েও পার্লামেন্টে বিতর্কও হয়েছিল। তবে তাতে খুব সায় ছিল না সরকারের।

“তবে আমরাও থেমে ছিলাম না। আমাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে অনেক এমপি ধীরে ধীরে আমাদের জনসভায় যোগ দিতে শুরু করলেন।”

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সামরিক সহায়তা দিতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ভারত।

সে কথা স্মরণ করে পল বলেন, “ভারত যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সামরিক সহায়তা দিতে সম্মত হল, তা নিয়ে কম হৈ চৈ হয়নি নানা দেশে।

“জাতিসংঘে সেসব তর্ক আমি ভুলিনি। দুটি দেশ ছাড়া (আমেরিকা ও চীন) সবাই বাংলাদেশে পাক বাহিনীর আগ্রাসন নিয়ে নিন্দা করতে শুরু করল। নিন্দা প্রস্তাব আসতে লাগল গণহত্যা নিয়ে।”

অগাস্টের পর পল কনেট ও তার সহযোগীরা মিলে গঠন করেন অপারেশন ওমেগা নামে একটি সংগঠন; যারা পরে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে রওনা হন বাংলাদেশের উদ্দেশে।

ওই দলে ছিলেন অন্তঃস্বত্তা এলেন কনেটও। ত্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে যশোরের কাছে সীমান্তে ধরা পড়লেন তিনি।

যুদ্ধ দিনের ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এলেন বলেন, “অস্ট্রেলিয়ান ফেলো স্নেগেনসহ ত্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার মুখেই বন্দি হলাম আমরা। মনে পড়ে, খুব বৃষ্টির রাতে রওনা হয়েছিলাম আমরা। ভোরের দিকে যশোরের কাছে ধরা পড়লাম।

“পাকবাহিনীর ক্যাম্পের বিশাল একটি কক্ষে রাখা হল আমাকে। সেখানে আরো অনেক নারী। আমি আঁতকে উঠলাম, কিশোরী মেয়েরা গর্ভবতী, শরীরে তাদের অসহ্য যন্ত্রণা। বুঝলাম, কী নির্যাতন হয়েছে তাদের উপরে। আমিও গর্ভবতী। ওদের কাতর মুখগুলো এখনও ভুলতে পারি না।”

এর কয়েকদিনের মধ্যে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হলো এলেন ও তার সহযোগীকে। তবে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে আসা এলেন হার মানেনি।

বিচারে তিনি স্বীকার করেন, বাংলাদেশকে সাহায্য করতেই এসেছেন।

দুই বছরের সাজা হয় এলেন ও তার সহযোগীর। তবে খুব বেশি দিন সাজা ভোগ করতে হয়নি তাদের। মিত্রবাহিনীর এক অভিযানে উদ্ধার হন এই দুজন; আর ক্যাম্পের সেই সব নারীরাও। 

তবে মুক্তির আনন্দে স্বামীর কাছে ফিরে যাননি এলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

এলেন বলেন, “মুক্তিযোদ্ধারা সারা দিন শেষে এসে রেডিওর নব ঘুরিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র শুনত। কী সব ঘোষণা হত, আমি বুঝতাম না। আমি খালি গান শুনতাম তাদের সঙ্গে। রবীন্দ্রসঙ্গীত হত। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব মন দিয়ে শুনতাম।”

যুদ্ধের পর আরও চারবার বাংলাদেশে এসেছেন কনেট দম্পতি।

নব্বইয়ের দশক থেকে পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে কাজ করতে শুরু করা পল যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে।

২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধে বন্ধুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ৬২ জন নাগরিককে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানায় বাংলাদেশ। তাদের মধ্যে ছিলেন কনেট দম্পতিও।

নিউ ইয়র্কের সেন্ট লরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক পল কনেট এখন কাজ করছেন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও পল কনেট ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর ছিলেন।

একাত্তরে বাংলাদেশের পক্ষে ভিন দেশে জনমত গড়ে তোলা রসায়নের অধ্যাপক পল কনেট প্রায় ৪৮ বছরের দেখায় বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী কণ্ঠে বলেন, এই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে অনেক দূর।

৭৮ বছর বয়সী পল কনেট বলেন, “স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেছে। এই বাংলাদেশ কোথা থেকে কোথায় এসেছে এখন।” 

বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের তরুণরা এখন সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত বলেও মনে করেন পল।

সম্প্রতি ঢাকা এসে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে আসেন পল কনেট ও এলেন কনেট। 

সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের রাজনীতির পাশাপাশি তারা দুজনে কথা বলেছেন রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও।

পল বলেন, “গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এসে বেশকটি জেলায় গেলাম। তোমাদের সড়কগুলো এখন উন্নত হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো চলছে। গ্রামগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম, সেখানেও উন্নয়ন হচ্ছে।

“তোমরা সত্যি কত কিছু করে দেখিয়েছ। বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। এই বাংলাদেশ এখন কত দূর যায়, সেটাই দেখার পালা।”

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রসঙ্গে এলেন কনেট বলেন, “রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তোমরা যা যা করেছ, কৃতিত্ব তোমাদের দিতেই হবে। তবে আর কোনো ভুল করলে চলবে না। এখন সময় এসেছে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে কথা বলা। রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার পেতে হবে। দ্রুত ফিরিয়ে নিতে হবে ওদের। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া ভীষণ জরুরি।”

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন পল ও এলেন কনেট।

প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রশংসা করে পল বলেন, “গোটা বিশ্বে দুই নারী নেত্রীর কথা বলতে গেলে আমি প্রথমেই বলব, তোমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা।

“অতিমানব নয়, তাকে খুব সাধারণ মানুষই মনে হয়েছে আমার। অনুপ্রেরণাদায়ী এই নেত্রীর দুই চোখে আমি স্বপ্ন দেখেছি, যে বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত ও দারিদ্র্যমুক্ত।”

পল ও এলেন কনেট এখন পরিবেশ সচেতনতায় গড়ে তুলেছেন ফ্লুরিড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক। পরিবেশের বিষাক্ততা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি এ নিয়ে বিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গেও কাজ করছেন এই যুগল।