তবুও কেমিকেলের গুদাম সরাতে নারাজ তারা

চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির জন্য সেখানকার বাড়িগুলোতে থাকা রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থকে দায়ী করা হলেও পুরান ঢাকার ওই এলাকা থেকে এই ধরনের গুদাম সরাতে স্পষ্ট আপত্তি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2019, 04:28 PM
Updated : 23 Feb 2019, 05:44 PM

অগ্নিকাণ্ডের তিন দিন পর শনিবার সেখানে রাসায়নিকের গুদাম খালি করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা; ওই অবস্থায় মেয়র সাঈদ খোকন গেলে তাকেও বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়।

বিক্ষোভকারীদের দাবি, এই অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে কেমিকেল কিংবা রাসায়নিকের কোনো সম্পর্ক নেই। অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে, বন্ধ করা দরকার গ্যাস সিলিন্ডার।

গত বুধবার রাতে চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় অন্তত পাঁচটি ভবন, যে ভবনগুলোর প্রায় প্রতিটিতে ছিল প্লাস্টিক দ্রব্য, রাসায়নিক কিংবা প্রসাধন সামগ্রীর গুদাম।

নয় বছর আগে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর পুরান ঢাকার সব রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছিল।

এবারের অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির জন্য দাহ্য পদর্থের গুদামকে দায়ী করা হলে পুরনো দাবিটি আরও জোরেশোরে উঠেছে।

যে চার তলা বাড়িটি সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, নন্দকুমার দত্ত লেনের সেই বাড়ি ওয়াহেদ ম্যানশনের পাশের পাঁচ তলা ভবনে শনিবার সকালে তালা ভেঙে অভিযান চালাতে গিয়ে স্থানীয়দের বাধা পান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

খবর পেয়ে দুপুরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন এসে ওয়াহেদ ম্যানশনের গুদামঘর থেকে রাসায়নিক কাঁচামাল সরাতে অভিযান শুরু করলে স্থানীয়রা শুরু করে বিক্ষোভ।

মেয়র কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিলে বিক্ষোভকারীদের একজন তেড়ে এসে বলেন, “সরকার কেমিকেল কেমিকেল কইতাছে, সরকার কেমিকেল কইতে কী বোঝায়, হেইডা কউক! এখানে সব ট্যালকম পাউডার, বডি স্প্রে, টায়ারের কালি, এইসব আছিল। এইগুলো কি কেমিকেল?”

“আর গুদামে কেমিকেল আছে বইল্যা আপনেরা সাংবাদিকরা যা কইতাসেন........কেমিকেলের কারণে আগুন লাগছে বলতাছেন.. আগুন তো লাগছে সিলিন্ডার থিকা। কেমিকেল এইখানে কেমনে দায়ী হয়,“ উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে বলেন তিনি।

ওয়াহেদ ম্যানশনের বেইসমেন্টের গুদাম থেকে রাসায়নিক পদার্থ উদ্ধার করেন মেয়র সাঈদ খোকন

আগুন নেভানোর পর ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান বলেছিলেন, “পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হত এখানে। সেই বোতলগুলো ব্লাস্ট হয়ে বোমার মতো কাজ করেছে। এছাড়া আরও অন্যান্য কেমিকেল ছিল।”

স্থানীয় ব্যবসায়ী আফতাব উদ্দিন বলেন, “ফুটেজ দেখেন গিয়া.... আগুন লাগছে পিকআপের সিলিন্ডার থিকা। আপনেরা দোষ দিতাছেন কেমিকেলের। কেমিকেল কেমিকেল কইরেন না। আগে গিয়া সিলিন্ডার বন্ধ করতে বলেন সরকারকে।

“আমরা কেমিকেল সরামু না। কেমিকেল এই এলাকাতেই থাকবে।”

চকবাজারের কসমেটিকস ব্যবসায়ী মো. আলীম বলেন, “কেমিকেলের কারণে আগুন লাগে নাই। গোডাউনের কারণে আগুন লাগে নাই। আমাদের কেমিকেলের গোডাউন ভাড়া দিতে হবেই। কেমিকেলের গোডাউন সরবে না।”

চকবাজারের এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত কীভাবে, সে বিষয়ে কোনো কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত তথ্য না দিলেও শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ুন তাৎক্ষণিকভাবে বলেছিলেন, একটি গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার থেকে বিস্ফোরণ ঘটে।

নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানাগুলো সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও স্থানীয়রাই সাড়া দেয়নি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক।

চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংসস্তুপে রূপ নেয় আশপাশের সব সড়ক

অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে রাসায়নিকের গুদাম জড়িয়ে গণমাধ্যমে ভুল ব্যাখ্যা আসছে বলে দাবি করেন স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী আফতাব উদ্দিন।

তিনি বলেন, “এই এলাকায় কোনো কেমিকেলের গোডাউন নাই। যা আছিল, সব আমরা বহুত আগে সরাইয়া দিছি।  এত আগুন লাগছে, গোডাউনে ক্ষতিকর কেমিকেল থাকলে তো আগুনে জ্বইলা যাইত। জ্বলছে? জ্বলে নাই। তাইলে কেমনে বলেন, সেখানে কেমিকেল ছিল।”

১৫ বছর আগের চকবাজারের হায়দার বখস লেনে এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের বাসিন্দা জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৫ বছর আগে সেই আগুনের ঘটনা থিকা আমরা আসলে কিছুই শিখতে পারি নাই। সেই ঘটনার পর এই এলাকা থেকে কেমিকেলের গোডাউন সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হইসিল।

“কিন্তু অনেক বাড়ির মালিক গোপনে নিজেরাই কেমিকেল গোডাউনে রাখছে। তাদের কেউ নিজেরাই এসবের ব্যবসা করে, কেউ ভাড়া দিয়া রাখছে।”

মেয়র খোকনের হস্তক্ষেপে সেই ওয়াহেদ ম্যানশনের বেইজমেন্ট থেকে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক উদ্ধার করা হয়; যে বাড়িটির উপরের চারটি তলাই আগুনের ক্ষত নিয়ে এখন কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পাশের আসগর লেনের হালিমা মার্কেটের কাপড়ের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, “এই গোডাউনে আগুন লাগলে পুরা চকবাজার তো উইড়াই যাইতই, লগে পুরা লালবাগও পুইড়া ছাই হইত।”

পোড়া ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় পারফিউমের ক্যানের স্তূপ, যা আগুনের সময় বোমা হয়ে উঠেছিল

পাইকারি বাণিজ্যের জন্য সুপরিচিত চকবাজারের বাসিন্দাদের অনেকে বলেন, অতিরিক্ত ভাড়ার লোভে বেশিরভাগ ভবন মালিক গুদাম ভাড়া দিচ্ছেন রাসায়নিকের ব্যবসায়ীদের। আর এনিয়ে কথা বলেও কোনো ফল হয় না।

কাপড়ের ব্যবসায়ী জাকির বলেন, “কতবার এই নিয়ে সিটি করপোরেশন অভিযান চালাইল, কত কিছু উদ্ধার করল, তারপর কী হইল! যে লাউ সেই কদু। আবার সেই কেমিকেল।”

হালিমা মার্কেটের আরেক ব্যবসায়ী মো. রফিক বলেন, “এই মার্কেটেও ব্যবসা করছি ভয়ে। কেমিকেলের গোডাউন থেকে কখন আগুন লেগে যায়।”

জাকির ও রফিক উভয়ই বলেন, এই এলাকাগুলোর বাড়ির মালিকরা অসচেতন হয়েই রাসায়নিকের জন্য গুদাম ভাড়া দিচ্ছেন। তারা জানতে ও মানতে ‘নারাজ’।

নন্দকুমার দত্ত লেনে ৩০ বছর ধরে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করে আসা জোৎস্না বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই এলাকার বিল্ডিংগুলার বেশিরগুলাতে প্লাস্টিকের কাঁচামাল জমায়া রাখত। সেদিন রাতে আগুন লাগার পর চারপাশে খালি প্লাস্টিকের দানা দ্যাখছেন না?”

স্থানীয় কয়েকজন বলেন, রাসায়নিকের গুদাম সরাতে কথা বলতে গেলেও বাধা পাওয়া যায় রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে।

বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পাওয়া গেছে ওয়াহিদ ম্যানশনের বেইসমেন্টের গুদাম থেকে

ষাটোর্ধ্ব এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কতবার গেছি থানায়। কেমিকেলের গোডাউন সরাইতে কইছি। শিল্পপতিরা পুলিশের নাকের ডগা দিয়া ব্যবসা করতাছে। কিন্তু কিছু হয় না, কোটিপতিদের হাতেই তো অহন প্রশাসন।”

এলাকায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ বাড়িতে প্লাস্টিকের কাঁচামালের গুদাম রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কারা জমাইছে, এইডা এলাকাবাসী জানে। কিন্তু তাদের কিছু কওনের উপায় নেই।”

ওয়াহেদ ম্যানশনের উল্টো দিকের ভবনের পেছনের অংশে মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ করে রাখাও দেখা যায়।

মেয়র সাঈদ খোকন এবার হুঁশিয়ার করেছেন, পুরান ঢাকার সব রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা অপসারণের কাজ শুরু করেছেন তারা, কারও বাড়িতে অবৈধ কেমিকেলের মজুদ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে দুপুর ২টার দিকে মেয়র চলে গেলেও স্থানীয়দের অনেকে ‘সিলিন্ডার নিষিদ্ধ কর’ বলে স্লোগান দিতে থাকে।

পরে সেখানে উপস্থিত হন পুরান ঢাকা ব্যবসায়ী ঐক্য ফ্রন্টের সভাপাতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক আবদুস সালাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কসমেটিকস ও প্লাস্টিক সামগ্রী মজুদের ক্ষেত্রে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের একটি নীতিমালার আওতায় দ্রুতই আনা হবে।”