ধলেশ্বরীর প্রায় সাড়ে ১১ একর জমির উপর ‘মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশনস লিমিটেড’ নামে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে উঠেছে, তাহজিব তার ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য তাহজিব আলম সিদ্দিকী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে। দশম সংসদে স্বতন্ত্র সদস্য তাহজিব এবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন।
ধলেশ্বরী দললে পেন্টা প্রপার্টিজ লিমিটেড ও জাগরণী চক্র নামে আরও দুইটি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ৪৬ ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও স্থানীয় ভূমি অফিসের জরিপে; যা প্রতিবেদন আকারে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন হাই কোর্টে দাখিল করেছে।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের হাই কোর্ট বেঞ্চে সোমবার এ প্রতিবেদন দুটি উপস্থাপনের পর শুনানি হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পূরবী সাহা; তার সঙ্গে ছিলেন পূরবী রানী শর্মা। জাতীয় নদী কমিশনের প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আইনজীবী এমদাদুল হক।
আদালতে রিট আবেদনকারী হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তাহজিব সিদ্দিকীর কোম্পানির পক্ষে শুনানিতে ছিলেন রাশনা ইমাম।
বিবাদী পক্ষের আবেদনে আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি মামলার পরবর্তী শুনানির দিন রেখেছে আদালত।
তারা হলেন, মানিকগঞ্জের সিংগাইরের ধল্লা ইউনিয়নের কলম মিয়া, আবেদ আলী, সামছুল হক, বছিরন, ইব্রাহীম মিয়া, নোমাজ আলী, ইদ্রিস আলী, আছিয়া খতুন, আনোয়ারা বেগম, আলী আকবর, সাহেদ আলী, সামছুদ্দিন, রফিকুল ইসলাম, আব্দুল আলী, জিন্নত আলী, আব্দুল জলিল, সুন্দর আলী, দেলোয়ার হোসেন ও ঢাকার মোহাম্মদপুরের জিয়াউদ্দিন আহাম্মেদ।
তাহজিবের মালিকানাধীন ‘মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশনস লিমিটেড’র দখলে ১১ দশমিক ৩০ একর জমি রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সংসদ সদস্য তাহজিব সিদ্দিকীকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। এসএমএস পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
জেলা প্রশাসকের দেওয়া প্রতিবেদনে নদীর অবৈধ দখল বন্ধে ধল্লা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে বলা হয়, ধল্লা মৌজার ধলেশ্বরী নদী ও নদী ফরশোর এলাকায় ঢাকা নর্দান পাওয়ার জেনারেশনস লিমিটেড (বর্তমানে মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশনস লিমিটেড) অবৈধ দখলের জন্য বালু ভরাট কাজ আরম্ভ করলে মৌখিকভাবে নিষেধ করা হয়। সে নিষেধ না মানলে গত বছরের ৩ মে প্রকল্পের পরিচালককে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসক গত বছরের ২০ জুন জমি ব্যবহারের অনুমতি না দিয়ে অবিলম্বে নদী ও নদীর ফরশোরের জমি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে আদেশ দিয়েছিলেন বিদ্যুৎ কোম্পানিটিকে। তারপরও জমি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে না দিলে গত বছরের ২৬ জুন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান নির্মাণাধীন প্রকল্পের স্থাপনা সাত দিনের মধ্যে অপসারণ এবং দিয়ারা জরিপ বাতিল করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন।
সে নির্দেশনা অনুযায়ী অবৈধ স্থাপনা অপসারণের জন্য গত বছরের ৩০ জুলাই সাত দিনের সময় দিয়ে সংশ্লিষ্টদের নোটিস দেন জেলা প্রশাসক। এর দুই দিন পর অর্থাৎ ২ আগস্ট জেলা প্রশাসক দিয়ারা জরিপও বাতিল করে।
এদিকে উচ্ছেদের নোটিস পেয়ে এটি চ্যালেঞ্জ করে মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক হাই কোর্ট রিট আবেদন করেন। তাতে বাদীর পক্ষে রায় হলে সরকারের পক্ষে আপিলের অনুমতি চেয়ে (লিভ টু আপিল) আবেদন করা হয়।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশনস লিমিটেডের দখলে থাকা ধলেশ্বরী নদীর সকল জমি প্লাবন ভূমির অন্তর্গত। এই কোম্পানির কেনা জমি রেজিস্ট্রি ও বিএস জরিপভুক্ত করে তা জারি করা আইনের সরাসরি লঙ্ঘন ও গর্হিত কাজ। এছাড়াও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মানিকগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীর জায়গা দখল করে ‘ডরিন পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্র’ শিরোনামে দৈনিক বনিক বার্তায় প্রতিবেদন প্রকাশ হলে তা যুক্ত করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ হাই কোর্টে রিট আবেদনটি করে।
ডরিন পাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও তাহজিব সিদ্দিকী। এই প্রতিষ্ঠানের একটি কোম্পানি হল ঢাকা নর্দার্ন পাওয়ার জেনারেশনস বা মানিকগঞ্জ পাওয়ার।
রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ২৩ অক্টোবর হাই কোর্ট রুল জারি করে।
ধলেশ্বরী নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ, অবৈধ স্থাপনা অপসারণে কেন বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং একইসঙ্গে ধলেশ্বরী নদী দখল করে ‘ডরিন পাওয়ার’র বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
তখনই ধলেশ্বরীর সীমানা নিরূপন ও অবৈধ দখল চিহ্নিত করে ৬০ দিনের মধ্যে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসককে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
ওই প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে দখলদারদের এ তালিকা ও চিত্র।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাওয়ার প্লান্ট কর্তৃপক্ষ দাবি করছিল, বিএস রেকর্ড আছে। সে ব্যাপারে কমিশন অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, সিএস, আরএসে নদীর জায়গা। যেহেতু এটা চর ছিল, তাই জেলা প্রশাসন ভূমিহীন কৃষকদের শুধুমাত্র চাষাবাদের জন্য লিজ দিয়েছিল। সেখানে শর্তই ছিল যে, এই জমি হস্তান্তর করা যাবে না। এখানে অন্য কোনো কিছু করা যাবে না।
“কিন্তু পাওয়ার প্লান্ট কর্তৃপক্ষ ওইসব ভূমিহীন কৃষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে, জোর করে সে জমি দলিল করে নিয়েছে। সেই দলিলবলে তারা মালিক হয়ে এখানে একটা দিয়ারা জরিপের জন্য আবেদন করে।
“দিয়ারা জরিপ যখন শুরু হয় তখন জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এটা নদীর জায়গা, ব্যক্তির নামে জরিপ হবে না। এই কথা বলার পরও জরিপ অধিদপ্তর তড়িঘড়ি করে রেকর্ড করে ব্যক্তির নামে দিয়ে দেয়।”
২০১৭ সালে ‘দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বিশেষ আইনে’ ডরিন পাওয়ারকে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ।