বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আগুন লাগার পর সরকারি হাসপাতালটিতে থাকা প্রায় সব রোগীকে সরকারি-বেরসরকারি নানা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
অগ্নিকাণ্ডে কেউ হতাহত না হলেও স্থানান্তরের সময় মারা গেছে গুরুতর অসুস্থ একটি শিশু।
চারতলা এই হাসপাতাল ভবনে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আগুন লাগার পর প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় তা নেভায় অগ্নিনির্বাপক বাহিনী।
অগ্নিকাণ্ডের খবরে সংসদ অধিবেশন থেকে হাসপাতালটিতে ছুটে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ।
আগুন নেভানোর পর রাতেই হাসপাতালের কার্যক্রম সীমিত আকারে সচল করা হয় বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ সচিব জি এম সালেহ উদ্দিন।
আতঙ্কের পর দুর্ভোগ
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে হাসপাতালটির মূল ভবন থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখে সবার মধ্যে দেখা দেয় আতঙ্ক। তখনই রোগীদের অনেকে ভয়ে বেরিয়ে আসতে থাকেন।
দ্বিতীয় তলার ওয়ার্ডে থাকা এক রোগীর স্বজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের একজন এসে বলে আগুন লাগছে আপনারা সবাই বাইরে চলে যান। তখন আমি আমার রোগীকে নিয়ে বাইরে চলে আসি।”
আরেক রোগীর স্বজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগুনের কথা শোনার পর তিনি ধোঁয়া উড়তে দেখেন। এই পরিস্থিতি দেখে তিনি তার রোগীকে নিয়ে বাসায় চলে যান।
ফেইসবুকে তোলা বিভিন্নজনের আগুনের ভিডিওতে সরকারি এই হাসপাতাল ভবনের উপরে ধোঁয়া উড়তে দেখা যাচ্ছিল।
এরপর সব রোগীকে বের করে আনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ; তাদের রাখা হয় হাসপাতাল প্রাঙ্গণ ও সামনের মাঠে। আইসিইউতে থাকা রোগীদের অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য হাসপাতালগুলোতে।
গুরুতর অসুস্থসহ কয়েকশ রোগীকে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে।
পরে অন্য রোগীদেরও বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে এর বাইরে অনেকের স্বজনরা নিজ নিজ উদ্যোগে তাদের রোগীদের নিয়ে চলে যান।
তবে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা এই রোগীদের কাউতে কাউকে কোথায় যাবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়তে দেখা গেছে।
আগুনের সূত্রপাত ঘটার পরপরই হাসপাতালটির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। সোয়া ৭টার দিকে বিদ্যুৎ ফিরে আসে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, “আগুন লাগার পর সবাইকে বের করে আনা হয়। কেউ হতাহত হয়নি।”
কত রোগী ছিল, তারা এখন কোথায়?
শেরে বাংলানগরের হাসপাতালটিতে ১২শ’র মতো রোগী ছিলেন বলে এর পরিচালক ডা. উত্তম বড়ুয়া।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাসপাতালে ১১ থেকে ১২শ রোগী ছিল। এর মধ্যে ১০ জন ছিল আইসিইউতে।”
এসব রোগীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ আশপাশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
পাশের কেয়ার হাসপাতালে ৩০ জন রোগীকে নেওয়া হয় বলে বেসরকারি এই হাসপাতালটির মহাব্যবস্থাপক মো. আবদুল্লাহ খান জানান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সোহরাওয়ার্দী থেকে ৩০ জন রোগীকে আনা হয়েছিল তাদের হাসপাতালে। এরমধ্যে ২৭ জন ভর্তি হয়েছেন; তার মধ্যে সাতজনকে রাখা হয়েছে আইসিইউতে।
কেয়ারে আনা একটি শিশুর মৃত্যুর খবরও দেন আবদুল্লাহ খান। অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সোহরাওয়ার্দীর শিশু ওয়ার্ড।
দেড় বছর বয়সী শিশুটিকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল বলে জানিয়ে আবদুল্লাহ খান বলেন, “শিশুটিকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিল। আগুন লাগার পর অক্সিজেন মাস্ক খুলে তাকে আনা হয়েছিল। আমরা তাকে ডেড হিসেবে পেয়েছিলাম।”
যে শিশুটি মারা গেছে, তার কোনো নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি।
আবদুল্লাহ খান বলেন, “ওই সময় এত হুড়োহুড়ি ছিল যে তা রাখার অবস্থা ছিল না। শিশুটির স্বজনরা সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে নিয়ে চলে যায়।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তাও একটি শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়ার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।
অগ্নিকাণ্ডের ফলে সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে আসতে বাধ্য হওয়া এই রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেয়ার কর্তৃপক্ষ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন আবদুল্লাহ খান।
রাতে আগুন নেভানোর পর সোহরাওয়ার্দীর জরুরি বিভাগ সচলসহ হাসপাতালের কার্যক্রম সীমিত আকারে চালু করার কথা জানান স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ সচিব জি এম সালেহ উদ্দিন।
তিনি বলেন, যেসব রোগী অন্য হাসপাতালে গেছেন, তারা চাইলে এখানে ফেরত আসতে পারেন, আবার যেখানে রয়েছেন, সেখানেই চিকিৎসা নিতে পারেন।
আগুন সূত্রপাত নিয়ে ভিন্ন বক্তব্য
আগুন কোত্থেকে লেগেছিল, তা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিসের ভিন্ন বক্তব্য এসেছে।
সরকারি এই হাসপাতালটিতে অগ্নিনির্বাপনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না বলে অভিযোগ এসেছে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে; তাতে কিছুটা সমর্থন মিলেছে অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর কর্মকর্তাদের কথায়ও।
চারতলা এই হাসপাতাল ভবনের তৃতীয় তলায় শিশু ওয়ার্ড থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে বলে হাসপাতালের পরিচালক উত্তম বড়ুয়ার মনে করছেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শিশু ওয়ার্ডে প্রথম আগুন লেগেছিল, পরে তা অন্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে।
হাসপাতালের এক কর্মচারীও বলেন, সন্ধ্যায় তিন তলায় প্রথম আগুন জ্বলতে দেখেছিলেন তারা।
তবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান বলছেন, আগুন প্রথমে লেগেছিল নিচ তলার স্টোর রুমে। সেখান থেকে তা উপরে ছড়িয়ে পড়ে।
তিন তলায় আগে আগুন লাগার বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, আগুনের ধর্ম নিচ থেকে উপরে ওঠে, উপর থেকে নিচে নামে না।
আলী আহাম্মেদ বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পরও স্টোরে অনেকগুলো কক্ষে তা জ্বলছিল, সেগুলোতে ঢুকে ঢুকে নেভাতে হয়েছি তাদের।
“ভেতরে ছোট ছোট আগুন আছে, স্মোক আছে। তবে আগুনটা বড় হচ্ছে না। আমরা এখন রুমগুলো চেক করে দেখছি,” রাত সোয়া ৮টায় বলেছিলেন তিনি, তার আধা ঘণ্টার মধ্যে আগুন পুরোপুরি নেভানো হয়।
এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ কী, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে না চাইলেও ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের ধারণা, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে এই আগুন লেগেছিল।
আগুন লাগার পর তা নেভানোর সরঞ্জাম খুঁজে না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন এক রোগীর স্বজন মো. আবদুল্লাহ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগুন লাগার পর আধা ঘণ্টা খুঁজেও নেভানোর সরঞ্জাম খুঁজে পাই নাই, তখন যদি নেভানোর সরঞ্জাম পেতাম, তাহলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না।”
সরকারি এই হাসপাতালে অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না বলে মত প্রকাশ করেছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক আলী আহাম্মেদ।
তিনি আরও বলেন, আগুন নেভাতে এসে প্রথমে পানি সঙ্কটে পড়েছিলেন তারা, তবে পরে তা কেটে যায়।
হাসপাতালটিতে আগুন লাগার পর অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে প্রথম পাঁচটি ইউনিট যায় নেভাতে। পরে ইউনিটের সংখ্যা ১৫টিতে উন্নীত হয়।