রোহিঙ্গা: মিয়ানমারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুপারিশ

এগার লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভারে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে ও হচ্ছে, তার জন্য মিয়ানমারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুপারিশ এসেছে এক গবেষকের কাছ থেকে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2019, 04:27 PM
Updated : 13 Feb 2019, 04:30 AM

অস্ট্রেলিয়ার সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটির এই গবেষক বলছেন, ২০১৭ সালের অগাস্টে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর এই পর্যন্ত ১৭ মাসে বাংলাদেশের সার্বিক ক্ষতির মূল্যমান ৬০০ কোটি ডলারের বেশি।

মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়টির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ড. মহসিন হাবিবের পাশাপাশি ওই বিশ্ববিদ্যালয়টির অধ্যাপক ক্রিস্টিন জাবও আরেকটি সমীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন, যাতে ক্ষতির এই চিত্র ফুটে ওঠে।

অনুষ্ঠানে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করে এই শরণার্থীদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে সরকার সচেষ্ট বলে জানান।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা মুসলিম রোহিঙ্গারা নিপীড়নের মুখে বহু দিন ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত চার লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিল।

দেড় বছর আগে রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হলে নতুন করে দেখা দেয় রোহিঙ্গা স্রোত। কয়েক মাসেই আট লাখ রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেয় এই দেশে।

এই ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে। তাদের বসতি স্থাপনের কারণে পরিবেশ ও স্থানীয়দের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি শুরু থেকেই রয়েছে আলোচনায়।

এর মধ্যেই কাকরাইলের আইডিইবি ভবন মিলনায়তনে ‘রোহিঙ্গা ক্রাইসিস : গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুপারিশ এল।

ড. মোহসিন তার প্রবন্ধে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে বলেন, “রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আর্থ সামাজিক, স্থানীয় মানুষের সমস্যা এবং জলবায়ুর ওপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলে সার্বিকভাবে যে ক্ষতি করেছে, তা ছয় বিলিয়ন (৬০০ কোটি) ডলারের বেশি। জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ১৭ মাসে বাংলাদেশের এই ক্ষতি হয়েছে।”

বিপরীতে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে রাখাইনে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাবদ মিয়ানমারের বছরে ২০০ কোটি ডলারের মুনাফার একটি হিসাব দেখান এই গবেষক।

পাহাড় কেটে বসেছে রোহিঙ্গা বসতি, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের

ড. মোহসিন বলেন, রোহিঙ্গাদের পালন করতে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্বের ২২ দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে বাংলাদেশ সাহায্য পেয়েছে মাত্র ৭৩ কোটি ডলারের মতো।

এই পরিস্থিতিতে ‘শিগগিরই’ মিয়ানমারের কাছে বাংলাদেশের এই ক্ষতিপূরণ দাবি করা উচিৎ বলে মত দেন তিনি। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিচারের জন্য মিয়ানমারের উপর চাপ বাড়ানোর আহ্বানও তিনি জানান।

রোহিঙ্গাদের উচ্চ জন্মহারের বিষয়টি তুলে ধরে ড. মোহসিন বলেন, “রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বছরে বাড়ছে ১০ ভাগের মতো। তাই যত দ্রুত সম্ভব তাদের ফেরাতে হবে।”

রোহিঙ্গাদের ফেরতে মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে বাংলাদেশকে জোর কূটনেতিক তৎপরতা চালানোর পরামর্শ দেন এই গবেষক।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, “এমনিতে আমাদের দেশে লোক বেশি, আয় কম। তার উপর এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের চাপ আমাদের দেশের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।

“তারা এখন আমাদের টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের পাঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করতে চাইছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হলেও অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদের ভার বহন করা বাংলাদেশের জন্য দুঃসাধ্য।

শরণার্থী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা খলীকুজ্জমানের।

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন টেরোরিজমের জন্ম হচ্ছে। এভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে গড়ে উঠলে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে। তখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।”

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “তাদের বিপদের সময় আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা নিয়ে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের ফিরিয়ে দিতে চাই।”

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান বলেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ ধেকে আশ্রয় দেওয়া হলেও এখন রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি বলেন, “অন্য দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়ার ব্যথা আমরা বুঝি। তাই আমরা এই শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার কাজ করেছি।

“এখন ঠাণ্ডা মাথায় এবং ধৈর্য ধরে মিয়ানমারের সাথে আলোচনা করে এই বিপুল শরণার্থীদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”

আন্তর্জাতিক চাপে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও প্রত্যাবাসন এখনও শুরু করা যায়নি। আতঙ্কিত রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফেরত যেতে চান না।

রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার সঙ্গে রাখাইনে বসবাসের পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমারকে চাপ দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।

পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান বলেন, “সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়, আমাদের সরকারের এই নীতির মাধ্যমেই আমরা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে পারব বলে আমরা বিশ্বাস করি।

“মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ লাখ বছর ধরে প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র আলোচনার মাধ্যমে এ সংকট সামাধান করতে হবে।”