সন্তানসম্ভবা ওএসডি ইউএনওর স্ট্যাটাসে তোলপাড়, যা বলছে প্রশাসন

সন্তানসম্ভবা এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) ওএসডির পর ফেইসবুকে তার পোস্ট নিয়ে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে জনপ্রশাসনে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকশহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Feb 2019, 03:13 PM
Updated : 11 Feb 2019, 03:38 PM

সন্তানসম্ভবা হওয়ায় ‘একজন বিশেষ কর্মকর্তা’ তাকে বিভিন্ন মহলে ‘অযোগ্য’ হিসেবে উপস্থাপন করে বদলির পাঁয়তারা করছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সদ্য সাবেক ইউএনও হোসেন আরা বেগম।

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৩০তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা বলছেন, ওএসডির খবর শুনে ‘প্রচণ্ড মানসিক চাপে তার ফুসফুসের রক্ত চলাচল অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায়’ অস্ত্রোপচার করে প্রিম্যাচিউর সন্তানের জন্ম হয়; যে শিশুটি স্কয়ার হাসপাতালের এনআইসিইউতে আছে।

গত শনিবার তিনি ফেইসবুক পোস্টে এই অভিযোগ তোলার পর সারা দেশে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

তবে জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলছেন, তার ‘ভালোর’ জন্যই ওই নারী কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই তিনি ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছেন।

যেভাবে ঘটনা

গত বছরের ১ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদরের ইউএনও হিসেবে নিয়োগ পাওয়া হোসনে আরাকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।

হোসনে আরার ফেইসবুক প্রোফাইল থেকে স্ট্যাটাসটি মুছে ফেলা হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে এর স্ক্রিনশট।

এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাত ১টা ৫০ মিনিটে তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন-

আমি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সাধারণত ফেসবুকে খুব একটা শেয়ার করি না। তবে আজ মনে হল এখন চুপ করে থাকাটাও অন্যায়। তাই আজ আর না, আজ আমি বলবো...

আমি হোসনে আরা বেগম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার নারায়ণগঞ্জ সদর, মাত্র ৯ মাস পূর্বে আমি এ পদে যোগদান করি। আমার দীর্ঘ ৯ বছরের দাম্পত্য জীবনে বহু চেষ্টা চিকিৎসার পরও আমরা কোনো সন্তান লাভ করতে পারিনি। কিন্তু পাঁচ মাস পূর্বে আমি জানতে পারি, আমি দুমাসের সন্তানসম্ভবা। এ ঘটনা আমার জীবনে সৃষ্টিকর্তার অপার রহমত ছাড়া আর কিছুই নয়- এ বিশ্বাস আমি প্রতিনিয়ত বুকে ধারণ করেছি। এ বিশ্বাস ও স্বপ্ন বুকে নিয়ে অনাগত সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনছিলাম।

উল্লেখ্য, আমি আমার বাবুকে পেটে নিয়েই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে আমি নারায়ণগঞ্জ ৪ ও নারায়ণগঞ্জ ৫ আসনের আংশিক নির্বাচন অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করি।

একজন নারী কর্মকর্তা হিসেবে অজুহাত ফাঁকিবাজি এই বিষয়গুলোকে কখনই পুঁজি করিনি। যখন যে পদে কাজ করেছি চেষ্টা করেছি শতভাগ নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে। সন্তানসম্ভবা হয়েও এর কোনো ব্যতিক্রম আমি করিনি।

অথচ আমি সন্তানসম্ভবা হয়েছি শোনার পর থেকেই একজন বিশেষ কর্মকর্তা, যার নাম বলতেও আমার রুচি হচ্ছে না, বিভিন্ন মহলে আমাকে অযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করে আমাকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে বদলির পাঁয়তারা করেই চলেছিল।

আমার সন্তানসম্ভবা হওয়াটাকেই সে বিভিন্ন মহলে আমার সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করেছে। অথচ এই সন্তান পেটে নিয়েই আমি অত্যন্ত সফলভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি, ও আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এপ্রিসিয়েশনও পেয়েছি। আমার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল এপ্রিলের ২০ তারিখ, তেমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আমি ছিলাম। গত ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখ বিকালে রেগুলার চেকাপ করতে আমি হাজব্যন্ডসহ স্কয়ার হাসপাতালে আসি, চেকআপ শেষে সন্ধ্যায় আমার হাসপাতালে অপেক্ষা করছি পরবর্তী পরীক্ষার জন্য এমন সময় আমার একজন ব্যাচমেট ফোন করে জানায়, আমার সদাশয় কর্তৃপক্ষ আমাকে ওএসডি করেছে অর্থাৎ আমাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেছে।

আমার অপরাধ হলো- আমি সন্তানসম্ভবা, আর তার চেয়েও বড় কারণ হল সেই তথাকথিত ক্ষমতাধর কর্মকর্তার উপরের মহল কর্তৃক তদবির। খবরটা শোনার পর আমি প্রচণ্ড মানসিক চাপ সহ্য করতে পারিনি, উল্লেখ্য আমি অ্যাজমার রোগী।

প্রচণ্ড মানসিক চাপে আমার ফুসফুসে ব্লাড সার্কুলেশন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, ফলে আমার পেটের সন্তানের অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় এবং হঠাৎ করেই আমার পেটের বাবু নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়।

তাৎক্ষণিক হসপিটালে ভর্তি করা হলে ডক্টর সেদিন রাতেই সিজার করে বাবু বের করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়, পরে আমার পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে পরদিন সকালে আমার মাত্র ৩১ সপ্তাহ বয়সী প্রিম্যাচিউর বেবিকে সিজার করে বের করে ফেলা হয়। এখন সে স্কয়ার হাসপাতালের এনআইসিইউতে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপন যুদ্ধ করে যাচ্ছে!!!

আমার এই নিষ্পাপ সন্তানটার কি অপরাধ ছিল??? নাকি মা হতে চাওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল আমি জানি না!!! তবে জানি একজন সব দেখেন, তিনি আমার নিষ্পাপ মাসুম সন্তানের উপর এই জুলুমের বিচার করবেন।

এই নিষ্ঠুর অমানবিকতার পৃথিবীতে কোন কর্তাব্যক্তিদের কাছে আমি এ অন্যায়ের বিচার চাই না, শুধু আমার সৃষ্টিকর্তাকে বলবো তুমি এর বিচার করো!!! আর যারা আমাকে একটুও ভালবাসেন আমার নিষ্পাপ সন্তানটার জন্য দোয়া করবেন, ও সুস্থ হয়ে গেলে কোনো কষ্টের কথাই আমার মনে থাকবে না।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহম্মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিছু দিনের মধ্যে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে।… মেয়েটি গর্ভবতী কিন্তু অসুস্থ। (ওএসডির) যে আদেশ আমার অনুবিভাগ করেছে তা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে আমি জাস্টিফাইড মনে করেছি। এটা কোনো অন্যায় করেননি, একদম যথার্থ করেছেন।”

হোসনে আরাকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশ।

সচিব বলেন, “জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে যে, তার প্রসবের তারিখ ছিল এপ্রিলে। ছয় মাসের ম্যাটারনিটি লিভের অর্ধেক সাধারণতা প্রসবের তিন মাস আগে ও তিন মাস পরে ভোগ করে।

“বদলির আগেও সে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। এ কারণে মন্ত্রণালয় মনে করেছে, যে কোনো নির্বাচন কিন্তু চ্যালেঞ্জিং। আর সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম সময়টা এবং শেষ সময়টায় প্রবলেম হয়, মাঝখানটা ভালো থাকে। মেয়েটা নিজেই স্বীকার করেছেন, উনি অ্যাজমার রুগী এবং ঢাকায় চেকআপে যান।

“এই মায়ের প্রতি এবং তার বাচ্চার প্রতি আমাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং পুরো ভালোবাসা রয়েছে। এই বিবেচনায় মনে করেছে যে, চ্যালেঞ্জিং জবের সময় যদি এই চাপ তার অসুস্থতা আরও বাড়িয়ে দেয় এজন্য তাকে ওএসডি করে ঢাকায় রাখা হয়েছে এবং তিনি ঢাকায় ট্রিটমেন্টে আছেন।”

কোনো ইউএনও ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকলে ওই পদে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া যায় না জানিয়ে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, “নির্বাচনের সময় একটা উপজেলা খালি রাখা কি সম্ভব? তার যদি এতই আগ্রহ থাকে তবে মাতৃত্বকালীন ছুটির পারে তাকে আবার ওই দায়িত্বে পাঠাব।”

ইউএনওদের বদলির এখতিয়ার এপিডির হাতে থাকার বিষয়টি তুলে ধরে ফয়েজ আহম্মদ বলেন, “যদি অবিচার হয়ে থাকে সে সচিবের কাছে আসতে পারেন। মন্ত্রণালয় ভালো করছে না বলে মনে করলে তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, মুখ্য সচিববের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, সেই সুযোগ তার ছিল।

“একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তিনি নিজে নিজে এটা করেছেন কি না- আমি সন্দেহ পোষণ করি। তাকে কেউ বিপথগ্রস্ত করার জন্য করল কি না? বাস্তবতা হল, যেখানে বিধিবদ্ধ অথরিটি আছে সেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক এটি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে আমি জানি না।

“আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, আমি সব বিশ্লেষণ করে দেখেছি। …আমি এখনও মনে করি ওই কর্মকর্তা (ফেইসবুকে স্ট্যাটাস) নিজে দিয়েছেন কি না বা আমাদের অথরিটিকে কেউ অসম্মান করার জন্য কেউ করেছে কি না আই ডোন্ট নো।”

সোমবার সন্ধ্যায় হোসেন আরার ফেইসবুক প্রোফাইলে ৯ ফেব্রুয়ারির ওই পোস্টটি দেখা না গেলেও ফেব্রুয়ারি মাসের বিভিন্ন দিনের স্ট্যাটাস ছিল। কিন্তু রাতে তার প্রোফাইলে গিয়ে দেখা যায়, সবশেষ স্ট্যাটাসটি গত ৮ ডিসেম্বরের, এর পরের আর কোনো স্ট্যাটাস নেই।

এ বিষয়ে কথা বলতে সোমবার রাতে হোসনে আরার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। বর্তমানে তিনি কোথায় অবস্থান করছেন, সে বিষয়েও কোনো তথ্য জানা যায়নি।