বাধা ঠেলেই এগিয়ে চলছেন তরুণ প্রকাশকরা

কাগজের দাম বাড়ছে, ছাপাখানায় সেকেলে প্রযুক্তি, সম্পাদনার লোকবলও কম, সেই সঙ্গে প্রকাশক সমিতির অসহযোগিতার কথাও বললেন তরুণ প্রকাশকরা।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Feb 2019, 04:44 AM
Updated : 9 Feb 2019, 09:56 AM

তাদের অনেকে দ্বিতীয় পেশা হিসেবে প্রকাশনা ব্যবসাকে বেছে নিলেও সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনাকেই দিচ্ছেন গুরুত্ব।

এবারের একুশের গ্রন্থমেলায় তরুণ প্রকাশকদের মধ্যে কেউ এসেছেন লিটল ম্যাগ আঙ্গিনা থেকে, কেউ এসেছেন মফস্বল থেকে, কেউবা প্রকাশনা ব্যবসায় এসেছেন নিজের প্রথম উপার্জনের সবটুকু বিনিয়োগ করে।

খ্যাতনামা লেখকদের পাশাপাশি তরুণ লেখকদের বই প্রকাশেও তারা এগিয়ে এসেছে।

প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে ২৫ শতাংশ ‘মানসম্পন্ন’ বই থাকলে তবেই গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায় প্রকাশনীগুলো। 

সেই বিচারে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বলছে, অনেক পুরনো প্রকাশনীর চেয়ে তরুণ প্রকাশকরা বইয়ের মান বিচারে এগিয়ে আছে।

এবার নতুন ১৬টিসহ শতাধিক বই নিয়ে প্রথমবারের মতো অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে এইচ এম সাদী খানের ‘শব্দভূমি’ প্রকাশনা।

শব্দভূমি থেকে কবি আসাদ চৌধুরী, সেলিনা হোসেন, নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ও গল্প সংকলনের পাশাপাশি বেশ ক’জন তরুণ লেখকের উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন ও ভ্রমণবিষয়ক বেশ কটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

সাদী সৃজনশীল বই প্রকাশনা ব্যবসায় এসেছেন এক বছরও পেরোয়নি। বইমেলায় অংশ নিতে তিনি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও ঋণ নিয়েছেন।

প্রকাশনা শিল্পে আসার পেছনের গল্প শোনাতে গিয়ে সাদী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা আমার মূল ব্যবসা নয়। আমি লেখালেখি করছি অনেক দিন। প্রকাশক, লেখকদের সঙ্গেও যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। সৃজনশীল কিছু করার তাগিদ থেকে প্রকাশনা ব্যবসায় এসেছি। এখান থেকেই নিজের আলাদা একটি পরিচয় তৈরি করতে চাই।”

লিটল ম্যাগ চত্বর থেকে এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্টল মিলেছে ভিন্ন চোখে প্রকাশনীর। এ বছর ২৩টি নতুন বইয়ের পাশাপাশি ১১৭টি বই রয়েছে এই প্রকাশনায়।

ভিন্ন চোখে’র স্বত্বাধিকারী আলী আফজাল খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভিন্ন চোখে আর পোস্টমর্টেম- নামে দুটি সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা করতে গিয়ে বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিল, প্রকাশনা বড় করব। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে আমরা একত্রিত হয়ে প্রকাশনা শুরু করলাম।”

এ বছর ৪০টি নতুন বইয়ের পাশাপাশি দুই শতাধিক বই মিলবে বাসিয়া প্রকাশনীতে।

সিলেটের এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী নওয়াব আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গল্প, কবিতার পাশাপাশি এই প্রথম মেলায় সুযোগ পেয়ে তারা প্রাধান্য দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প ও সিলেটের মরমি গানকে।

২০০৫ সালে প্রকাশনা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হলেও অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এতদিন তাদের সুযোগ মেলেনি।

নওয়াব আলী বলেন, “মানসম্মত বই প্রকাশের শর্ত তো রয়েছে, পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই প্রকাশ করতে হবে বলেও বাংলা একাডেমির অলিখিত একটা শর্ত আছে। সেই শর্ত পালন করতে গিয়ে আমাদের অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে। খ্যাতনামা লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা দুরূহ ব্যাপার। তাদের লেখা সংগ্রহ করা, রয়্যালিটি ইস্যু- এসব তো চাট্টিখানি কথা নয়।”

নিজেদের জমি বিক্রির টাকা থেকে প্রকাশনা সংস্থা শুরু করা নওয়াব আলী মনে করেন, প্রতি বছর নির্দিষ্ট সংখ্যক জেলাভিত্তিক প্রকাশনাকে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ঠাঁই দেওয়া উচিৎ।

“এতে স্থানীয় প্রকাশকরা শুধু উৎসাহ পাবে না, বইমেলায় অংশ নেওয়ার জন্য মানসম্মত বইও প্রকাশ করবে।”

ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার জলতরঙ্গ প্রকাশনা গত তিন বছর ধরে ছিল বাংলা একাডেমির বহেরাতলার লিটল ম্যাগ চত্বরে।

এর স্বত্বাধিকারী তরুণ প্রকাশক সোলায়মান শিপন নিজের টিউশনির সব টাকা জমিয়ে এবার গ্রন্থমেলার স্টল বরাদ্দের অর্থ পরিশোধ করেছেন। এখন এই প্রকাশনাই তার মূল পেশা।

গল্প, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে ৩৫টি নতুন বই তিনি এবার প্রকাশ করেছেন।

লিটল ম্যাগ চত্বর থেকে এবার প্রথমবারের মতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঠাঁই পেয়েছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নৃ। ছয় লেখক বন্ধু তোলা প্রতিষ্ঠানটি এবারের বইমেলায় ২৫টি নতুন বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। ইতোমধ্যে এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়েছে ১৫ টি বই।

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নৃ’র অন্যতম স্বত্বাধিকারী মো. হাফিজুর রহমান বলেন, “সাত বন্ধুই অন্য পেশায় জড়িত। তবে আমরা সম্মিলিতভাবে নৃ’কে দাঁড় করাতে চাইছি। আমরা শুধু মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশে সীমাবদ্ধ থাকব না, আমরা পুরো বছর জুড়ে বই প্রকাশ করব।”

মানের প্রশ্নে ‘ছাড় নয়’

গ্রন্থমেলায় অংশ নেওয়া তরুণ প্রকাশকরা বলছেন, এখন তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বইয়ের মান ধরে রাখা।

মানসম্মত বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকরা নিজ উদ্যোগে আলাদা সম্পাদনা পর্ষদ খুলেছেন, যার কয়েকটিতে যুক্ত হয়েছেন খ্যাতনামা লেখকদের কেউ কেউ।

শব্দভূমির সম্পাদনা পর্ষদে রয়েছেন কবি কবি আসলামী সানী, আহমেদ ফারুক ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক রেহান কৌশিক।

শব্দভূমির স্বত্বাধিকারী সাদী খান বলেন, “বই প্রকাশের আগে আমরা পাণ্ডুলিপি সম্পাদনায় বিশেষ মনযোগী হই। রাষ্ট্র ও ধর্মবিরোধী কোনো লেখাকে আমরা উৎসাহিত করি না। এছাড়া পাণ্ডুলিপিতে অশ্লীল, উদ্ভট কিছু পেলে আমরা তা সাথে সাথে বাতিল করে দেই। এবারও অনেকে এসেছিলেন পাণ্ডুলিপি নিয়ে। কিন্তু আমরা তা বাতিল করে দিয়েছি।

“পাণ্ডুলিপি সম্পাদনায় আমরা বড় কঠোর। একচুলও ছাড় দেই না । আমাদের সম্পাদনা পর্ষদ পাণ্ডুলিপি দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালে পরে আমরা বই প্রকাশের উদ্যোগ নেই।”

ভিন্ন চোখে’র আলী আফজাল খান বলেন, “লিটল ম্যাগ সম্পাদনার সময় আমাদের আলাদা একটি সম্পাদনা পর্ষদ ছিল। সেই একই পর্ষদ এবার বইমেলার পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার কাজ করেছে। সহজ ও নির্ভুল বানানরীতি, বাক্য বিন্যাস এসব বিষয়ে নজর রেখেছি। বিষয়বস্তুর প্রতি সতর্ক থেকেছি। গল্প বা উপন্যাস পড়ে পাঠক যেন বিরক্ত না হয়, সেজন্য বইয়ের পাণ্ডুলিপিতে যেন ধারাবাহিকতা থাকে সেদিকে নজর রেখেছি।”

নৃ’র আরেক স্বত্বাধিকারী অনুপ কুমার বলেন, “যারা কাব্যরীতিতে লিখছেন, তাদের যেন ছন্দ ঠিক থাকে তেমনিভাবে গদ্যরীতিতে মাত্রা, ধারাবাহিকতা যেন ঠিক থাকে, গল্পের উপাত্ত যেন ঠিক থাকে সেদিকে ফোকাস করেছি আমরা।”

র‌য়্যালিটি ইস্যুতে সতর্ক অবস্থানে  

বইয়ের র‌য়্যালিটি ইস্যুতে সতর্ক অবস্থানে থাকছেন তরুণ প্রকাশকরা।

বাসিয়ার প্রকাশক নওয়াব আলী বলেন, “মফস্বলের প্রকাশনী বলে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের অনেকেই আমাদের পাণ্ডুলিপি দিতে চান না। যারা দিচ্ছেন, তাদের রয়্যালিটি আমরা আলোচনা সাপেক্ষে দিচ্ছি। বিশেষ পাণ্ডুলিপির ক্ষেত্রে সাইনিং মানি, রয়্যালিটি  একটু বেশি হয়। তরুণদের ক্ষেত্রেও আমরা সতর্ক, লক্ষ্য রাখি, তারা যেন নিজেদের বঞ্চিত মনে না করে।”

জলতরঙ্গ তরুণ লেখকদের জন্য বই বিক্রির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রয়্যালিটি দেয় বলে জানান এর স্বত্বাধিকারী শিপন। বই বিক্রির ১৫ শতাংশ রয়্যালিটি দেয় শব্দভূমি।

সাদী খান বলেন, “বইয়ের একটি এডিশন শেষ হলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে লেখককে ১৫ শতাংশ রয়্যালিটি মানি দিয়ে দেই। এটা খ্যাতনামা ও তরুণ লেখক উভয়ের ক্ষেত্রে দেই।”

বই বিক্রয়ের কত শতাংশ রয়্যালিটি দেওয়া হবে এ নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত না হলেও ‘বইয়ের মান বিবেচনায় আলোচনা সাপেক্ষে’ রয়্যালিটি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নৃ প্রকাশন।

আছে কিছু অভিযোগ

কাগজের মূল্য বৃদ্ধির পর বাঁধাই, সম্পাদনায় পুস্তক প্রকাশক সমিতির ‘সিন্ডিকেট বিজনেসের’ অভিযোগ এনে তরুণ প্রকাশক সাদী খান বলেন, “সৃজনশীল প্রকাশক সমিতিকে এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে। পাশাপাশি সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনাকে অনুপ্রেরণা দিতে সরকারেরও এগিয়ে আসতে হবে।”

ভিন্ন চোখে’র স্বত্বাধিকারী আলী আফজাল খান বলেন,  প্রকাশনা সংস্থাগুলোর বই বিপণন প্রক্রিয়া এখনও পেশাদারিত্বের জায়গায় পৌঁছায়নি।

“ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে বড় বুক স্টলগুলোতে যখন আমরা বই দিয়ে আসছি, তখন সেখান থেকে বই বিক্রির অর্থ আমরা ঠিকমতো পাই না। অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্মগুলো তখন ভরসা।”

‘অনেক ক্ষেত্রে মানে এগিয়ে তরুণ প্রকাশকরা’

তরুণ প্রকাশকদের বিষয়ে ইতিবাচক ধারণাই পোষণ করছে মেলার দুই আয়োজক বাংলা একাডেমি এবং জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি।

বাংলা একাডেমির বিপণন বিভাগের পরিচালক ও গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, “মানসম্মত বই প্রকাশের ক্ষেত্রে তরুণ প্রকাশকরা অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছেন প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রকাশনী থেকে। শতকরা হিসাব করতে গেলেও অনুপাতে অনেক ক্ষেত্রে নতুনরা এগিয়ে থাকে।”

পুরো বইমেলা জুড়ে বাংলা একাডেমি বইয়ের মান বিচারের জন্য যে আলাদা ভিজিলেন্স টিম গঠন করেছে, সে টিম আলাদাভাবে নতুনদের নজরে রাখবে বলে জানান জালাল আহমেদ।

বাসিয়ার নওয়াব আলী প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই প্রকাশের যে শর্তের কথা বলেছেন, তা অস্বীকার করে জালাল আহমেদ বলেন, “ এ ধরণের কোনো নির্দেশনা বাংলা একাডেমি থেকে কখনও দেওয়া হয় না।”

জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তরুণ প্রকাশকদের মধ্যে অনেকেই এখন নিরীক্ষাধর্মী বই প্রকাশে এগিয়ে আসছে। ভালো ভালো বই বের করার চেষ্টা করছে। প্রতিষ্ঠিতদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারাও সামিল হচ্ছে।”

শব্দভূমির সাদী খানের অভিযোগ সম্পর্কে কথা বলতে পুস্তক প্রকাশক সমিতির বইমেলার কার্যালয়ে গেলেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে সে সমিতির নেতাদের ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তারা কেউ সাড়া দেননি।