অপরাধ প্রমাণ হলেও ‘অবস্থা বিবেচনায়’ রনির যাবজ্জীবন

তিন বছর আগে রাজধানীর ইস্কাটনে গুলি চালিয়ে দুজনকে হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2019, 09:29 AM
Updated : 30 Jan 2019, 02:01 PM

দুই দফা পেছানোর পর ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল ঈমাম বুধবার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

যাবজ্জীবন সাজার সঙ্গে রনিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক।

রায় ঘোষণা করে তিন বলেন, “৩০২ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হলেও আসামির মানসিক ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হল।”

এর আগে রনির শারীরিক ও মানসিক অবস্থার বর্ণনায় বিচারক বলেন, “গুলির ঘটনার সময় রনি যে স্বাভাবিক ছিলেন না মর্মে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন। তার শিশু সন্তান অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিল, সেটাও ঠিক।

“ঘটনার সময় তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন বলে তার সঙ্গী ও মামলার সাক্ষীর জবানবন্দিতে উঠে এসেছে।”

তবে রায়ে সন্তুষ্ট নন জানিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী ওমর ফারুক রায়ের পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা আপিল করবেন।

“সাক্ষ্য দিতে এসে সাক্ষীরা কখনো বলেননি যে রনি গুলি ছুড়েছেন। তবে এ কথা তারা ম্যাজিস্ট্রেট ও আইওর কাছে বলেছে। আদালতের শপথ করে দেওয়া সাক্ষ্য ও রায়ের মধ্যে কন্ট্রাডিকশন দেখছি। আমরা মনে করছি, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আমরা পুরো রায় পর্যালোচনা করে উচ্চ আদালতে যাব।”

অন্যদিকে আসামির সর্বোচ্চ সাজা না হলেও রায় নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম জাহিদ হোসেন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সাক্ষীদের সাক্ষ্য, কল লিস্ট ও ভিডিও ফুটেজের ভিত্তিতে আমরা অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। তবে বিচারক আসামির অবস্থা বিবেচনা করে রায় দিয়েছেন।”

জাহিদ হোসেন বলেন, “বাদীপক্ষ, রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ সবাই এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় ছিল। যে ঘটনা ঘটেছিল, সেটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও দুঃখজক। এই ঘটনার বিচার হোক, সেটা সবার কাম্য ছিল।”

২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে ঢাকার নিউ ইস্কাটনে একটি গাড়ি থেকে ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে আবদুল হাকিম নামের এক রিকশাচালক এবং ইয়াকুব আলী নামের এক অটোরিকশাচালক আহত হন।

পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ এপ্রিল হাকিম এবং ২৩ এপ্রিল ইয়াকুব মারা যান।

এ ঘটনায় নিহত হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম রমনা থানায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন।

তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ওই বছর ৩১ মে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের তৎকালীন এমপি পিনু খানের বাসা থেকে তার ছেলে রনিকে আটক করে জানায়, তিনিই সেদিন গাড়ি থেকে গুলি ছুড়েছিলেন।

সিসিটিভির ভিডিও

আলোচিত এই জোড়া খুনের রায় ঘোষণার আগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কারাগার থেকে ঢাকা জজ কোর্টের হাজতখানায় আনা হয় রনিকে।

এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তাকে দোতলার আদালতকক্ষে নেওয়া হয়। অন্য একটি মামলার শুনানি শেষ করে পৌনে ৩টার দিকে রায় ঘোষণা শুরু করেন বিচারক। মোটামুটি ১০ মিনিট রায় ঘোষণা করে তিনি এজলাস ত্যাগ করেন।

রনির পিস্তলটি লাইসেন্স করা ছিল- এমন প্রমাণ আসামিপক্ষ উপস্থাপন করতে পারেনি বলে রায়ে জানান বিচারক।

এ সময় আসামির একজন আইনজীবী লাইসেন্সের কাগজ দেওয়া হয়েছে বললে বিচারক বলেন, “লাইসেন্স সংক্রান্ত একটি ফটোকপি দেওয়া হয়েছে মাত্র।”

বিচারক মঞ্জুরুল ঈমাম বলেন, “তদন্ত কর্মকর্তা আসামির কাছ থেকে ২১ রাউন্ড গুলি উদ্ধারের কথা জানিয়েছেন। তবে আসামির গুলি কেনার হিসাব, তিনি কত রাউন্ড গুলি খরচ করেছেন, সেই সংক্রান্ত কোনো তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হয়নি।”

রনির মোবাইল ফোনের কললিস্ট ও জনকণ্ঠ ভবনের সামনের সিসিটিভি ফুটেজ মামলাটি প্রমাণে সহায়তা করেছে বলে রায়ে উল্লেখ করেন বিচারক।

তিনি বলেন, ঘটনার আগে-পরে রনির গাড়ি আসা-যাওয়ার প্রমাণ ভিডিও ফুটেজে ছিল।

বিচারে যা যা জানা গেছে

মামলা হওয়ার তিন মাসের মাথায় ২০১৫ সালের ২১ জুলাই রনিকে একমাত্র আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন গোয়েন্দা পুলিশের এসআই দীপক কুমার দাস।

‘খুনের উদ্দেশ্য না থাকলেও’ আসামি জানতেন যে তার গুলিতে কেউ হতাহত হতে পারে- এই যুক্তিতে হত্যার অভিযোগ এনে এ মামলায় ৩০২ ধারায় অভিযোগপত্র দেন তিনি।

নিহতদের শরীরে পাওয়া গুলির ব্যালাস্টিক রিপোর্ট, রনির অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের প্রতিবেদনসহ মোট ১৫টি আলামত অভিযোগপত্রের সঙ্গে যুক্ত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষে মোট ৩৪ জনকে সাক্ষী করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এরপর ২০১৬ সালের ৬ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে জোড়া খুনের এ মামলায় রনির বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার দ্বিতীয় মহানগর দায়রা জজ সামছুন নাহার।

রনির গাড়িচালক ইমরান ফকির এবং ঘটনার সময় গাড়িতে থাকা তার দুই বন্ধু ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন।

ঘটনার দিন কালো রঙের যে গাড়ি থেকে রনি গুলি চালিয়েছিলেন, সেটি সংসদ সদস্য পিনু খানের বলে গণমাধ্যমে খবর আসে সে সময়।

রনির বন্ধু কামাল মাহমুদ ঢাকার হাকিম আদালতে জবানবন্দিতে বলেছিলেন, লাইসেন্স করা পিস্তল থেকে সাংসদপুত্রই সেদিন গুলি ছুড়েছিলেন।

রনির পিস্তলের গুলিতেই ইয়াকুব ও হাকিমের মৃত্যু হয় বলে পরে ব্যালাস্টিক পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়ার কথা জানায় পুলিশ।

এই সাংসদপুত্রের গাড়িচালক ইমরান ফকিরকেও গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তবে সাক্ষী হওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।

আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে ইমরান বলেন, ওই রাতে সোনারগাঁও হোটেল থেকে রনিকে নিয়ে তিনি মগবাজার মোড় হয়ে ইস্কাটনের বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। সে সময় ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের জন্য রাস্তার একপাশ বন্ধ ছিল।

“আমাদের গাড়ির বাঁ দিকে ও পেছনে দুটি ট্রাক ছিল। রাস্তায় ছিল জ্যাম। জ্যামে আটকা থাকা অবস্থায় রনি সাহেব এক পর্যায়ে হাত বের করেন। এর কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ শোনা যায়।”

তবে সাংসদপুত্র রনি আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।

দুই দফা রায়ের তারিখ বদল

বিচার চলার মধ্যেই ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে মামলাটি প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়।

২৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আল মামুন রায়ের জন্য গতবছর ৮ মে তারিখ ঠিক করে দেন। কিন্তু এর মধ্যেই আসামিপক্ষের এক আবেদনে মামলাটি ফের বদলি করা হয় দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে।

নতুন আদালতের বিচারক মঞ্জুরুল ঈমাম ‘অধিকতর’ যুক্তিতর্ক শুনানির প্রয়োজন বোধ করায় রায় পিছিয়ে যায়। দুইপক্ষ আবার তাদের বক্তব্য আদালতের সামনে তুলে ধরে। গতবছর ১৯ সেপ্টেম্বর পুনরায় যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে বিচারক রায়ের জন্য ৪ অক্টোবর দিন রাখেন।

কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তাকে নতুন করে তলবের আবেদন করায় রায় আবার পিছিয়ে যায়।

ওই সাক্ষ্য নেওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ১৫ জানুয়ারি রায়ের নতুন তারিখ ঠিক করে দেন বিচারক।

পুরনো খবর-