পশ্চিমারা চাপে রেখে সুবিধা নিতে চায়: মোমেন

বাংলাদেশের নির্বাচন, মানবাধিকার, জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রশ্ন তোলার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য থাকার কথা বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2019, 06:44 PM
Updated : 21 Jan 2019, 06:46 PM

তার ভাষ্য, পশ্চিমা দেশগুলো নানা সুবিধা নেওয়ার জন্য চাপে রাখতে এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে ‘তৌফিক ইমরোজ খালিদী লাইভ’ অনুষ্ঠানে একথা বলেন নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের দিনই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রথমবার সংসদ সদস্য হয়েই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া মোমেন।

বাংলাদেশে সদ্য অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পশ্চিমা দেশগুলো। এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল তারা।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েও উদ্বেগ জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো।

এবিষয়ে এক প্রশ্নে মোমেন বলেন, “পৃথিবীর যেসব দেশ আপনাকে চাপের মধ্যে রাখতে চায়, তারা বিভিন্ন রকমের টুল ব্যবহার করে। এর মধ্যে মানবাধিকার, টেররিজম, গণতন্ত্র- এই রকম অনেক টুল।”

বাংলাদেশকে চাপের মধ্যে রাখতে চায় কি না- তৌফিক খালিদীর এ প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “চাপের মধ্যে রাখলে অনেক সুবিধা।”

জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনে দায়িত্ব পালনের সূত্রে দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা মোমেন মনে করেন পশ্চিমাদের নানা কথা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে অযাচিত গুরুত্ব পায়।

“আমার খুব দুঃখ লাগে। যখন আমাদের এখানে একজন নাপিতকে মেরে ফেলল, তখন পশ্চিমা একটি মহিলা (রিটা কাৎজ), যে এবং তার অ্যাসিট্যান্ট একটি অফিস চালায়। সে বলল, এটার সঙ্গে সন্ত্রাসের সম্পর্ক আছে। আর আমার আমাদের মিডিয়া কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে ফলাও করে ছাপায়।”

বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “ইটস এ টু ওয়ে রিলেশনশিপ। আমরা যেমন পণ্য দিই, তারাও কিন্তু আমাদের থেকে পণ্য বাধ্য হয়েই নেয়।”

নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দেশের প্রশ্ন তোলার বিষয়ে মোমেন বলেন, “পৃথিবীর অনেক দেশে নির্বাচন হয়। কিন্তু কোথাও মডেল নির্বাচন আপনি পান না। আমেরিকা; পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে হয় না।

“আমাদের দেশের স্বচ্ছ নির্বাচন হয়েছে, প্রায় ৩৯ দল ও সকল মতের লোকের নির্বাচন হয়েছে। আমি যতগুলো ভোটকেন্দ্রে গিয়েছি, তাদের (বিএনপির) পোলিং এজেন্ট ছিল। তারা এক লাখের মতো ভোট পেয়েছে।”

পৃথিবীর প্রায় সব দেশই এবারের নির্বাচনকে ‘স্বাগত জানিয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

বিএনপির অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, “বিএনপি হচ্ছে বাংলাদেশ নালিশ পার্টি। এজন্য তারা সবসময় নালিশ নিয়ে থাকেন। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা যায়, তাদের প্রার্থী ফল প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু পরে দেখা গেল তাদের প্রার্থী জিতে গেছেন। এরপর কিন্তু তারা কোনো কথা বলেন না।”

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশির সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কাও অমূলক বলে উড়িয়ে দেন বিশ্ব সংস্থাটিতে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি মোমেন।

“ইউএন নেয়, কারণ আমরা প্রফেশনালি অনেক কমপিটেন্ট। আমরা এগুলোতে খুব উপযুক্ত। আমাদের মহিলা পুলিশ দুনিয়াতে যা দেখাল। এটা আমরা ভিক্ষা করে নিইনি।”

 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সফরে ভারত যাচ্ছেন বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন মোমেন।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের গত ১০ বছরের শাসনকালে ভারতের সঙ্গে বন্ধন আরও গাঢ় হওয়ার পাশাপাশি চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে।

চীন ও ভারতের নিজেদের বিরোধের মধ্যেও দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মধুর সম্পর্ক রেখে চলার জন্য শেখ হাসিনাকে কৃতিত্ব দেন মোমেন।

তিনি বলেন, “বিরাট শক্তি ভারত ও গণচীন। ভারতের সাথে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক, আমাদের প্রতিবেশী। আর চীন আমাদের অর্থনৈতিক বন্ধু। এই দুইজনকে ব্যালেন্স করে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কূটনীতি নির্ধারণ করেছেন। এটা অভূতপূর্ব।”

৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর দিন সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে শুভেচ্ছা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার কয়েক ঘণ্টার মাথায় ‍ফুল নিয়ে শেখ হাসিনার কাছে হাজির হন চীনের রাষ্ট্রদূত।

দুই দেশের এই ‘প্রতিযোগিতার’ বিষয়ে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, “শুধু ফুল নয়, কাঠের নৌকা নিয়ে হাজির হয়েছে।

“আপনি কি এ নিয়ে গর্ববোধ করেন না? আমাদের সম্পর্কে কোনো ছাড় নাই। আমরা খুব উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখছি।”

“প্রতিযোগিতার মধ্যেই আমরা বেঁচে থাকি,” দুই দেশের প্রতিযোগিতা নিয়ে তৌফিক খালিদীর প্রশ্নের জবাবে বলেন মোমেন। 

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে চীনের ভূমিকার প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “কূটনীতি আর রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নাই। আমার বিশ্বাস, আমরা সমাধান করতে পারব। কারণ সবগুলো দেশই আমাদের সাথে আছে।”

দুই বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেনা অভিযানের মুখে মুসলিম রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করে। সে দফায় সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তার আগে থেকে এদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে আরও চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা।

এই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেও প্রত্যাবাসন এখনও শুরু করা যায়নি।

রোহিঙ্গা সঙ্কট অবসানে চীনের ভূমিকার গুরুত্বের কথা বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় আসছে।

মোমেন বলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যা আমাদের অনেক জটিল ও অত্যন্ত কঠিন সমস্যা। মিয়ানমার আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র হলেও তাদের মনমানসিকতা রোহিঙ্গা সম্পর্কে অত্যন্ত নিম্নমানের। আমরা অনেক অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছিলাম। কিন্তু এগুলো ধীরগতির।”

“আমি সবসময় অপটিমিস্ট। আমার বিশ্বাস, এই সমস্যা সমাধান করতে পারব,” বলেন তিনি।

রোহিঙ্গা সঙ্কট দীর্ঘায়িত হলে প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোর জন্যও সেটা সমস্যা হবে বলে মনে করেন মোমেন; ফলে তিনি আশাবাদী, এই জটিলতার অবসানে থাইল্যান্ড, ভারতসহ অন্য দেশগুলোও এগিয়ে আসবে।

চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ পদক্ষেপে বাংলাদেশ এক হলেও তাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরবে না বলে মনে করেন নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

“আমরা অর্থনৈতিক কানেকটিভিটির উপর জোর দিয়েছি। সেই কানেকটিভিটির জন্য আমরা এনার্জি কানেকটিভিটি, আমাদের সড়কের কানেকটিভিটি, আমাদের এভিয়েশন কানেকটিভিটি- এসবে যদি আমাদের কেউ সহযোগিতা করে আমরা অবশ্যই সেটা গ্রহণ করি।”

ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি করতে না পারা এবং সেদেশে গিয়ে বাণিজ্য করতে বাংলাদেশের সুবিধা করতে না পারার বিষয়টি নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন সাংবাদিক তৌফিক খালিদী।

উত্তরে মোমেন বলেন, “বাংলাদেশ তিস্তা পায়নি। যেগুলো পেয়েছি সেগুলো দেখেন। আমরা স্থল সীমানা পেয়েছি, মহাসোপান পেয়েছি, বিরাট একটি সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছি। আগে অনেকগুলো লোক মারা যেত, এখন সেগুলো কমে গিয়েছে। আমাদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক বাড়ছে। অনেকগুলো আইটেমে তারা আমাদেরকে ছাড় দিয়েছে। আমরা অনেক পাচ্ছি। আমরাও দিয়েছি।”

আসামের নাগরিকত্বের সমস্যাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, “এটা তাদের ইন্টার্নাল ইস্যু। বর্তমানে নির্বাচনের কারণে হয়ত এটাকে চাঙ্গা করা হচ্ছে। এটা নিয়ে আমাদের ক্ষতির কোনো শঙ্কা নাই। সম্পর্কেও কোনো প্রভাব পড়বে না।”

মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক মন্ত্রীদের সতর্ক করার বিষয়েও অনুষ্ঠানে কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন।

তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী সিনসেয়ারিট অব পারপাস ও সিনসেয়ারিট অব কমিটমেন্টের উপর জোর দিয়েছেন। দুর্নীতিতে শূন্য সহিষ্ণুতার বিষয়ে কথা বলেছেন।”

মন্ত্রীরা দুর্নীতি করলে কী হবে- এই প্রশ্নে মোমেন বলেন, “তিনি (শেখ হাসিনা) বলেছেন, শাস্তি হবে। মন্ত্রী হলেও কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”

এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে বলেই মনে করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

সদ্য বিদায় নেওয়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই মোমেন এবারই প্রথম নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর শেখ হাসিনার নতুন সরকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান তিনি।