ডাকসু নির্বাচন: ভোটকেন্দ্র নিয়ে দুই মত সংগঠনগুলোতে

ডাকসু নির্বাচনে ভোটার কিংবা প্রার্থী কারা হতে পারবেন, সে বিষয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো একমত হলেও দ্বিমত দেখা গেছে ভোটকেন্দ্র নিয়ে।

তারেক হাসান নির্ঝর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2019, 04:05 PM
Updated : 21 Jan 2019, 04:18 PM

সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও তাদের মিত্র সংগঠনগুলো আগের মতোই হলগুলোতে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের পক্ষে অবস্থান জানিয়েছে।

অন্যদিকে তার বিরোধিতা করেছে ছাত্রদল ও বাম ছাত্র সংগঠনগুলো। তারা একাডেমিক ভবনগুলোতে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করেছে।

তবে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সান্ধ্যকালীন মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদেরও ভোটার করার ক্ষেত্রে সব ছাত্র সংগঠনগুলোই সহমত প্রকাশ করেছে।

তিন দশক পর আদালতের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ার পর সোমবার ক্রিয়াশীল সব ছাত্রসংগঠনকে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় 'পরিবেশ পরিষদ'র বৈঠক করেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।

১৯৯০ সালের পর আর ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় সক্রিয় ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিয়ে পরিবেশ পরিষদ গঠন করে বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্রদের মতামত শুনে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

পরিবেশ পরিষদের এদিনের বৈঠকটি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের উপাচার্য কার্যালয় সংলগ্ন আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে।

ডাকসু ভবন আছে, কিন্তু নির্বাচন হয় না তিন দশক

সকাল সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত এই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক এস এ মাহফুজুর রহমান, ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটির আহ্বায়ক ড. মিজানুর রহমানসহ হলগুলোর প্রাধ্যক্ষরাও উপস্থিত ছিলেন।

ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের দুই অংশ, জাসদ ছাত্রলীগের দুই অংশ, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রমৈত্রী, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র আন্দোলনসহ ১৪টি ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা অংশ নেন বৈঠকে।

ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নেতারা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর যারা স্নাতকোত্তরের অন্য কোর্সে ভর্তি হয়েছেন, তাদের ভোটার করার সুপারিশ জানিয়েছেন তারা।

যারা দ্বিতীয়বার মাস্টার্স করছে এবং ডাকসু ও হল সংসদের ফি দিচ্ছেন, তাদের ভোটার করার দাবি বৈঠকে জানান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী। তিনি সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীদেরও ভোটার করার দাবি জানান।

ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী নিয়মিত শিক্ষার্থীর পাশাপাশি এমফিল, পিএইচডির শিক্ষার্থীদেরও ভোটার করার দাবি জানান।

ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান ডাকসুর ফি যারা পরিশোধ করেন, তাদের সবাইকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।

পরিবেশ পরিষদের সভার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান

অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে যে গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি হয়েছে, সেখানে ৬ বছরের মধ্যে স্নাতক ও ২ বছরের মধ্যে স্নাতকোত্তর করা শিক্ষার্থীরাই ডাকসুর ভোটার ও প্রার্থী হতে পারবেন বলে সুপারিশ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় পাস হলেই তা গঠনতন্ত্রে যুক্ত হবে।

কমিটির এ সুপারিশ যদি সিন্ডিকেটে পাস হয়, তাহলে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নসহ ক্রিয়াশীল ১৪টি সংগঠনের শীর্ষনেতাদের অধিকাংশই ভোট করতে পারবেন না।

ডাকসুর সঙ্গে প্রতিটি হল সংসদের নির্বাচনও হবে। বরাবর আবাসিক হলেই ভোটকেন্দ্র হয় এবং ভোটাররা সেখানেই দুটি ব্যালটে একটি হল সংসদ এবং একটি কেন্দ্রীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোট দেন। 

ভোটকেন্দ্রের ক্ষেত্রে বর্তমান এই নিয়মই রাখার পক্ষে অবস্থান জানায় ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগসহ ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'ভুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলো।

তবে হলে কেন্দ্র হলে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন না বলে আশঙ্কা অন্য সংগঠনগুলোর।

ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশনসহ 'প্রগতিশীল ছাত্রজোট' এবং ছাত্রদল একাডেমিক ভবনে ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়ে ভোটকেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর সুপারিশ করেছে।

ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “ভোট কেন্দ্র ক্যাম্পাসের একাডেমিক ভবনে আনার জন্য প্রশাসনের কাছে অধিকাংশ ছাত্র সংগঠন দাবি জানিয়েছে। আমরাও একই দাবি জানিয়েছি।”

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স বলেন, “আমরা ক্যাম্পাসে ভোটকেন্দ্র করার দাবি জানিয়েছি, যাতে সবার সহাবস্থান থাকে।”

সভাশেষে পরস্পরের হাত ধরে একসাথে বেরিয়ে আসেন ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ও ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান। একসাথে দাঁড়িয়েই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তারা। এরপর আকরামুল হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক বাশার সিদ্দিকীকে ভিসি চত্বর পর্যন্ত এগিয়ে দেন রাব্বানী।

পরিবেশ পরিষদের সভার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী

ছাত্রদল নেতা আকরামুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা এখানে যেমন সহাবস্থানে সভা করেছি, তেমনভাবে মধুর ক্যান্টিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সহাবস্থান কার্যকর করার পর তফসিলের দাবি জানিয়েছি। অন্যান্য সংগঠনও সহাবস্থানের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে।

“ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে এনে কলাভবন, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে স্থাপনের দাবি জানিয়েছি আমরা।”

গঠনতন্ত্রে ডাকসুর সভাপতির (উপাচার্য) ‘একচেটিয়া ও অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা’ সংশোধনের দাবিও জানিয়েছেন বলে জানান আকরামুল।

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাব্বানী সাংবাদিকদের বলেন, “এখন ডিজিটাল যুগে দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম হলকেন্দ্রিক, তাই ভোটকেন্দ্র হলের মধ্যে করা হোক।”

বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদল বরাবরই অভিযোগ করে আসছে, তাদের হলে কিংবা ক্যাম্পাসে তৎপরতা চালাতে দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ।

সহাবস্থান নিয়ে আকরামুলের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাব্বানী সাংবাদিকদের বলেন, “ক্যাম্পাসে সহাবস্থান আছে। ছাত্রদলকে ইতিবাচক ধারায় আসতে হবে, তাহলে তারা সহাবস্থান করতে পারবে।”

ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগের জবাবে ছাত্রলীগ নেতা বলেন, “ছাত্রদল অন্তর্কোন্দলের কারণে ক্যাম্পাস ছেড়েছে। তাদের মধ্যে যারা নিয়মিত শিক্ষার্থী, তারা প্রভোস্টের মাধ্যমে হলে থাকলে আমাদের সমস্যা নেই।”

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক প্রিন্স বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গঠিত নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ এবং আচরণবিধি কমিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

তিনি বলেন, “আমরা শুনেছি যারা এই দুই কমিটিতে দায়িত্ব পেয়েছেন তারা সবাই একটা দলের। আমরা চাই, সকল সংগঠনের নেতাদের পরামর্শ নিয়ে এইসব কমিটি গঠন করা হোক।”

পরিবেশ পরিষদের বৈঠকে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা

সভা শেষে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, “গঠনতন্ত্র নিয়ে যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা সিন্ডিকেট সভায় উঠবে। সেখানে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

যারা ভোটার হবে, তারা প্রার্থীও হতে পারবে বলে নিশ্চয়তা দেন তিনি।

আচরণবিধি বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সে বিষয়টি দেখবেন।”

আগামী ফেব্রুয়ারির শুরুতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ইঙ্গিত ইতোমধ্যে দিয়েছেন প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান।

তফসিলের বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, “আমরা একটা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে তফসিল দেওয়া হবে। আমরা ৩১ মার্চের মধ্যেই নির্বাচন করতে চাই। আমরা এপ্রিলে যেতে চাই না।”

তবে তফসিল  কবে হবে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলতে চাননি তিনি।

এই মতবিনিময় সভায় উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানীও ছিলেন।