ভোট শেষে স্বস্তিতে ইসি

বিরোধী জোট প্রশ্ন তুললেও সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করে টানা কয়েক মাসের ব্যস্ততার পর এখন স্বস্তিতে নির্বাচন কমিশন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Jan 2019, 03:15 PM
Updated : 3 Jan 2019, 03:25 PM

একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের চার দিন পর বৃহস্পতিবার ঢাকার আগারগাঁওয়ে  নির্বাচন ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নির্ভার দেখাচ্ছিল সিইসি কে এম নূরুল হুদা ও তার সহকর্মীদের।

ভবন প্রাঙ্গণে ফোয়ারা চত্বরে ‘ধন্যবাদ জ্ঞাপন’র এই অনুষ্ঠানে কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও ছিল স্বস্তির ভাব।

অনুষ্ঠানে আয়োজন হয় পিঠা উৎসবের; ভবনের জলাশয়ে বড়শী দিয়ে মাছ শিকার করে তার বার-বি-কিউ করে খাওয়া হয় অনুষ্ঠানে।

অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা বলেন, বিশ্বের কোনো দেশ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান কিংবা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেনি। এটি ইসি সচিবালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবার সফলতা।

পাঁচ বছর আগে অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচন হওয়ার পর একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দলকে এনে দলীয় সরকার রেখে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ ছিল নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশনের সামনে।

দুই বছর আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বিএনপিকে সব দলকে ভোটে এনে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ইতিহাস গড়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন।

মাঝে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বক্তব্যের জন্য কিছুটা বিতর্কে পড়লেও বাকি সময় কোনো সমস্যা হয়নি তার; শুধু বিভিন্ন নির্বাচনের পর বিএনপির কাছ থেকে সমালোচনা শুনতে হচ্ছিল।

এসব নিয়েই গত ৮ নভেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন নূরুল হুদা; পরে বিএনপির দাবির প্রেক্ষাপটে ভোটগ্রহণের দিন এক সপ্তাহ পেছানোও হয়। আর তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ার পর নূরুল হুদা বলেছিলেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও প্রতিযোগিতামূলক’ নির্বাচনের প্রথম আশা তার পূরণ হয়েছে।

তফসিলের পর থেকে টানা অভিযোগ করে আসছিল বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। অভিযোগের প্রতিবিধান না পাওয়ার অভিযোগ তুলে তারা ভোটের কয়েকদিন আগে সিইসির পদত্যাগের দাবি তুললেও ভোটের মাঠ থেকে সরেনি।

তবে গত ৩০ ডিসেম্বর ভোটের ফল ঘোষণার পর সংবাদ সম্মেলন করে ‘ভোট ডাকাতি’র অভিযোগ তুলে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানায়, যা সিইসি পরদিনই নাকচ করে দেন।

৩০০ আসনের নির্বাচনে মাত্র সাতটি আসনে জয়ী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তারপরও তাদের দাবিতে বৃহস্পতিবার দুপুরেই সিইসিকে স্মারকলিপি দেয়।

ওই স্মারকলিপি নেওয়ার পর বিকালে নির্বাচন ভবনে সব পর্যায়ের সহকর্মীদের নিয়ে অনুষ্ঠানে এক হন নূরুল হুদা। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, কবিতা খানমের পাশাপাশি ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদসহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এতে যোগ দেন।

নূরুল হুদা বলেন, “জাতীয় সংসদ নির্বাচন জাতির জন্য বড় একটা কাজ। আমি বারবার বলেছি, এ নির্বাচন শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এটি সারা বিশ্বের জন্য। নির্বাচন যখন সমাপ্ত হল, তারপর পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে, বিভিন্ন কমিউনিটি (সম্প্রদায়) থেকে আমাদের এই নির্বাচনের ব্যাপারে কমেন্ট করেছে। তারা তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছে। এই নির্বাচনকে তারা সফল নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করেছে।”

সিইসি কে এম নূরুল হুদা

রাশিয়া থেকে পড়াশোনা করে আসা নূরুল হুদা বলেন, “সাইবেরিয়া থেকে শুরু করে ভোলগা নদীর পাড় দিয়ে, প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে আমেরিকা, ইউরোপ সর্বত্র নির্বাচনের বার্তা আমরা পৌঁছে দিয়েছি। সেখান থেকে শীতের হাওয়ায় ঢেউয়ে ঢেউয়ে আমাদের কাছে এখানে চলে এসেছে।”

“কী আসেনি? এসেছে?”- সিইসির এই প্রশ্নে উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উত্তর আসে-  “হ্যাঁ।”

সিইসি আবার বলেন, “সেটা কেমন করে হল? পৃথিবীর কোনো দেশ, কোনো সংস্থা নির্বাচনের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছে? নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেছে?”

“কারণ, এটা আপনাদের বিজয়। এটা আপনাদের স্বার্থকতা। এটা আপনাদের সাফল্য, সকলের সাফল্য,” নিজেই উত্তর দেন তিনি।

নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণকে স্বাগত জানালেও ভোটের দিন সহিংসতায় অন্তত ১৭ জনের মৃত্যুতে উদ্বেগ জানিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো।  ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ভোটে অনিয়মের অভিযোগের পূর্ণ তদন্তও চেয়েছে।

সিইসি নূরুল হুদা ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের প্রশংসা করে বলেন, “ইলেকশন কমিশনের সুযোগ্য সচিব, দক্ষ সচিব, যার দক্ষ নেতৃত্বে এত বড় একটি কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হল।”

ভোটের আগে বিএনপির আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু যেমন ছিলেন সিইসি, তেমনি ছিলেন হেলালুদ্দীন। সরকারি কর্মকর্তা হেলালুদ্দীনকে ‘দলীয় লোক’ হিসেবে দেখে আসছে দলটি।

মাহবুব তালুকদারের মুখে সিইসির স্তুতি

পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনে সিইসি কে এম নূরুল হুদার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মতভেদ ছিল আলোচনায়। ভোট শেষে সেই মাহবুব তালুকদারের মুখেও শোনা গেল নূরুল হুদার বন্দনা।

সিইসিকে ‘বিশেষভাবে ধন্যবাদ’ জানিয়ে মাহবুব তালুকদার অনুষ্ঠানে বলেন, “তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং যোদ্ধার মতোই তিনি এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সবাইকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার

“অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, যাদের সঙ্গে আমার প্রতিদিন দেখা হয় এবং একটা কথা আমি বলব, অপরিসীম অনুগ্রহ আমি যাদের সঙ্গে দুই বছরের কাছাকাছি সময় অতিবাহিত করেছি, আরও তিন বছর অতিবাহিত করতে পারব আশাকরি এবং তাদের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, এ সম্পর্ক এত নিবিড়, এটি কর্মক্ষেত্রে কখনও হয়নি, হওয়া সম্ভব না।”

নূরুল হুদার মতোই সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মাহবুব তালুকদার একজন সাহিত্যিকও। ইসিতে নানা বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে বক্তব্য দেওয়া মাহবুব তালুকদারকে ‘বিএনপির লোক’ বলে আসছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

ভোটের ঠিক আগে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত হয়েছে কী হয়নি- তা নিয়ে সিইসির সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে ছিলেন মাহবুব তালুকদার। তার আগে ইভিএম নিয়ে তার ইসি সভা বর্জনও ছিল আলোচিত।

তফসিলের পর সহিংসতায় কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ জানানো মাহবুব তালুকদার নির্বাচন শেষে এদিনের অনুষ্ঠানে বললেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটি ‘ঐতিহ্য’ সৃষ্টি করবে।

“আমাদের নির্বাচনের কোনো ধারাবাহিকতা নেই কিংবা ছিল না। আমরা কখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করেছি, কখনও সেনা সমর্থিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করেছি, কখন নির্বাচন করেছি দলীয় সরকারের অধীনে। কিন্তু তা অংশীদারিত্বমূলক হয়নি।

“এই প্রথম একটা অংশীদারিত্বমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমরা জাতিকে উপহার দিতে পেরেছি। আমি মনে করি, এই নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি করবে। এই নির্বাচন ধরেই পরবর্তী ইতিহাসে যে নির্বাচনের ধারা, সেটা পরবর্তী সময়ে হয়ত ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে।”

অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

মাহবুব তালুকদার ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশংসা করে বলেন, “এই বিশাল কর্মযজ্ঞের যিনি কেন্দ্রবিন্দু, আমাদের নির্বাচন কমিশনের সচিব মহোদয় এবং তার সঙ্গে এখানে যারা পরবর্তী নির্বাচন সৈনিক ছিলেন, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপ-সচিব এবং অন্যান্য যারা ছিলেন, তারা কি নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই নির্বাচনকে সফল করেছেন, এই অভিজ্ঞতাও আমার জন্য অনেক বিশাল এক অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।”

নিজের চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি খুব ভাগ্যবান, নিজে নিজেই বললাম। তার কারণ হল, আমি আমার জীবনের প্রারম্ভে যখন সরকারের চাকরিতে আসি, তখন বঙ্গবভবনে আমি পাঁচ বছর কাটিয়েছিলাম। চারজন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমরা সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সেটা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত।”

চাকরি জীবনে দীর্ঘ সময়েও সহকর্মীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে মাহবুব তালুকদার বলেন, “আমি মনে করি এটা আমরা পরম সৌভাগ্য যে, তাদের সঙ্গে অত্যন্ত আপনজনের মতো আমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গেও আমার একটা অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক রয়েছে।

“জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ চারজন নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আমার আবার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সেজন্য আমি মনে করি, জীবনের প্রথম আমলা হিসেবে কাজ করা এবং জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আরও পাঁচ বছর, এগুলো আমার জীবনে গৌরবগাথা হয়ে থাকবে।”