সাংসদের দায়িত্বে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকার শপথ

আইন মেনে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে দেশের আইনসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েছেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সাংসদরা।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবসাজিদুল হক ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Jan 2019, 05:51 AM
Updated : 3 Jan 2019, 11:32 AM

বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার পর জাতীয় সংসদের শপথ কক্ষে এই শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। চার ভাগে মোট ২৮৯ জন এদিন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন। বিএনপি ও তাদের জোট ঐক্যফ্রন্টের কেউ শপথ নেননি।

শুরুতেই দশম সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী একাদশ সংসদের এমপি হিসেবে নিজের শপথ নেন। এবারের নির্বাচনেও রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

স্পিকার শপথ বাক্য পাঠ করার পর প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে উঠে হাত তালি দেন। পরে শিরীন শারমিন শপথপত্রে সই করেন। 

পরে তিনি অন্যদের শপথ পড়ান। প্রথমে সংখ্যগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের শরিক দলের কয়েকজন শপথ নেন।

একাদশ সংসদের এমপিরা নিজ নিজ নাম উচ্চরণ করে স্পিকারের সঙ্গে পড়তে থাকেন- “সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি, তাহা আইন-অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; এবং সংসদ-সদস্যরূপে আমার কর্তব্য পালনকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দেব না।”

এরপর সবাই শপথপত্রে নিজেদের আসনের নাম লিখে সই করেন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সংসদ সচিব জাফর আহমেদ খান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তার হাতে শুভেচ্ছার ফুল তুলে দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।

শপথ অনুষ্ঠানে প্রথম সারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডান পাশে ছিলেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও খন্দকার মোশাররফ হোসেন। আর বাঁ পাশে ছিলেন সাজেদা চৌধুরী, শেখ সেলিম, ওবায়দুল কাদের, মোহাম্মদ নাসিম, আব্দুর রাজ্জাক।

নাজমুল হাসান পাপনের পাশে ছিলেন নতুন দুই সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা ও শেখ তন্ময়।

প্রথম ভাগেই ২৫৫ জন নবনির্বাচিত সাংসদ শপথ পাঠ করেন, যাদের মধ্যে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মাহি বি চৌধুরী ও জাসদের (আম্বিয়া) মইনুদ্দিন খান বাদলও ছিলেন।

দ্বিতীয় দফায় শপথ নেন আওয়ামী লীগের শরিক চৌদ্দ দল ও মহাজোটের নয়জন এবং তিনজন স্বতন্ত্র এমপি।

ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদের হাসানুল হক ইনু, শিরিন আক্তার, জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বাশার মাইজভাণ্ডারি, বিকল্পধারার আবদুল মান্নান এবং স্বতন্ত্র নিক্সন চৌধুরী ছিলেন তাদের মধ্যে।  

এরপর দশম সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে শপথ নেন জাতীয় পার্টির নবনির্বাচিত ২১ জন সাংসদ।

গত ৩০ ডিসেম্বর ভোটে নির্বাচিত ২৯৮ জনের মধ্যে ঐক্যফ্রন্টের সাতজন শপথ নেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিকালে স্পিকারের কক্ষে আলাদাভাবে শপথ নেবেন বলে সংসদ সচিবালয় থেকে জানানো হয়েছিল, কিন্তু ‘শারীরিক অসুস্থতার কারণে’ তিনিও আসেননি। 

পার্টির কো চেয়ারম্যান জি এম কাদের পরে সাংবাদিকদের বলেন, “তিন চার দিনের মধ্যে তার শপথ নেওয়ার কথা রয়েছে। তা না হলে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শপথ নেবেন আমাদের চেয়ারম্যান।”

এছাড়া বিদেশে চিকিৎসাধীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শপথ নেওয়ার জন্য সময় চেয়ে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছেন।

স্পিকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনি দেশে ফিরে আসার পর শপথ নিতে চান। এমনিতেই ৯০ দিন সময় উনি পাবেন।”

 

# সংসদ নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশের তিন দিনের মধ্যে শপথের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

# এরপর ৩০ দিনের মধ্যে অধিবেশন ডাকতে হবে।

# প্রথম অধিবেশন শুরুর ৯০ দিনের মধ্যে শপথ না নিলে বা স্পিকারকে অবহিত না করলে সদস্য পদ খারিজ হবে।

শপথ অনুষ্ঠান শেষে সংসদের ভিআইপি ক্যাফেটারিয়ায় নতুন এমপিদের জন্য ছিল চা-চক্রের আয়োজন।

আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হওয়া ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা শপথ নেওয়ার পর সাংবাদিকদের বলেন, “খেলা ও রাজনীতি দুটোই একসাথে চালিয়ে যাব। দুটোতেই ভালো করার চেষ্টা করব।”

স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন বলেন, “এলাকাকে সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত করতে সবাই মিলে কাজ করব। এলাকার উন্নয়নের অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করব।”

দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৯৯টিতে গত রোববার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়, গোলযোগের কারণে একটি আসন স্থগিত রেখে সেই রাতেই ২৯৮টি আসনের ফল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।

এর মধ্যে ২৫৭টি আসনে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীরা। আর জোটগতভাবে তাদের আসন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮৮টি। এই নিরঙ্কুশ জয়ে টানা তৃতীয়বারের মত সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

এর বিপরীতে বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবি হয়েছে। তাদের ধানের শীষের প্রার্থীরা মাত্র সাতটি আসনে জয়ী হতে পেরেছে।

ভোটে বাধা দেওয়া, এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া এবং কারচুপির অভিযোগ তুলে ঐক্যফ্রন্ট ফলাফল বাতিল করে পুনঃভোটের দাবি তুললেও নির্বাচন কমিশন তা নাকচ করে দিয়েছে।

বিএনপির শপথ না নেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মাহি বি চৌধুরী বলেন, “এবার জনগণের ম্যান্ডেটটা অনেক বড়। তাই দায়িত্বটাও অনেক বড়। সেই দায়িত্বটা আমরা দায়িত্বশীলতার সাথে পালন করতে চেষ্টা করব। যারা আমাকে ভোট দিয়েছেন, আমার ওপর আস্থা রেখেছেন, বিশ্বাস করেছেন তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।”

বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে যারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছেন, তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “তারা নির্বাচিত হলেও শপথ নিতে আসেননি। জনগণ তাদের ম্যান্ডেড দিয়েছে। সেটা নেওয়ার পরেও যারা সংসদে আসেননি তারা জনগণের সাথে প্রতারণা করছেন।”

এবারের নির্বাচনকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ শপথ নেওয়ার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ নির্বাচনে জনগণ বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসনের জবাব দিয়েছে।”

জাসদের একাংশের কার্যকরী সভাপতি মইনউদ্দিন খান বাদল বলেন, নির্বাচনের আগের বিএনপির যে ‘দ্বিধাবিভক্তি’ ছিল, তা এখনো ‘কাটেনি’। গতবার নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি এবার শপথ না নিয়ে ‘আাবার ভুল করছে’।

[প্রতিবেদনটি তৈরি করতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন রিয়াজুল বাশার ও জয়ন্ত সাহা]