রাইড শেয়ারিং নিয়ে অনেক অভিযোগ

সিএনজি অটোরিকশা চালকদের স্বেচ্ছাচারে অতিষ্ঠ ঢাকাবাসীর সামনে স্বস্তির হয়ে দেখা দিলেও কয়েক দিন না যেতেই রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর সেবা নিয়েও বিড়ম্বনা ও ভোগান্তিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। কখনও কখনও ঘটছে যৌন হয়রানির মতো গুরুতর অপরাধের ঘটনাও।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Jan 2019, 11:20 AM
Updated : 2 Jan 2019, 03:53 PM

ব্যস্ত সময়ে বেশি ভাড়া আদায়ে অ্যাপ বাদ দিয়ে চুক্তিতে যাওয়া, গন্তব্যে যেতে চালকদের অনীহা, অনুরোধ গ্রহণ করে যাত্রী না নিয়ে চলে যাওয়া, নিয়ম না মেনে গাড়ি চালানো এবং বেশি ট্রিপের জন্য দ্রুত গাড়ি চালানোর অভিযোগ অনেকটা নিয়মিতই।

রাইড শেয়ারিং সেবা ঢাকায় জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করেছে সরকার। শর্ত ভঙ্গের জন্য প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধসহ দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে নীতিমালায়। কিন্তু এই সেবায় অহরহ ওই শর্তগুলোর লংঘন ঘটলেও কোনো জবাবদিহির মুখে পড়তে হচ্ছে না কাউকে।

বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বিআরটিএর; কিন্তু বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলো এখনও তালিকাভুক্ত না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না তারা।

বিআরটিএর পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো নীতিমালা মানতে বাধ্য। কিন্তু এখনও নিবন্ধন না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া যাচ্ছে না।

রাইড শেয়ারিং নীতিমালার ৩ (খ) ধারা অনুযায়ী যে কোনো দূরত্বে যাত্রী বহনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানছেন না অনেক চালক।

নিয়মিত উবারের রাইড নেওয়া বাড্ডার বাসিন্দা শহীদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মোবাইল অ্যাপে রাইডের অনুরোধ পাঠালে প্রায় অর্ধেক চালকই গন্তব্য জানতে চান।

“রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেই ‘কোথায় যাবেন’ এই প্রশ্ন করেন। আমি রাইড শেয়ারিং নীতিমালা পড়ে দেখেছি, এটা নীতিমালার পরিপন্থি। এছাড়া বেশিরভাগ উবার চালক ম্যাপ ফলো করে ঠিকমতো পিক-আপ পয়েন্টে আসতে জানেন না। আর নির্ধারিত রুট না মেনে অন্য রুটে যান, যে কারণে ভাড়া বেশি আসে- এটাও ঠিক না।”

রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হয়ে চলাফেরা বেশ সহজ হলেও এর বেশ কিছু সমস্যা আছে বলে মন্তব্য করেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী রাশেদুল আলম। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের এই বাসিন্দা বলেন, নিয়মিত রাইড নিয়ে প্রায়ই সমস্যায় পড়তে হয় তাকে।

“রাইড একসেপ্ট করে গন্তব্য জানতে চায়। তার মনমতো না হলে যায় না, ক্যান্সেল করে দেয়। আবার রাইড একসেপ্ট করে না নিয়েই চলে যায়। কোম্পানিগুলোয় অভিযোগ করেও তেমন সাড়া পাওয়া যায় না।”

গন্তব্য জানতে চাওয়া এবং অনুরোধ গ্রহণের পর তা বাতিল করলে চালকদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত বলে মনে করেন গুলশানের একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আশা পাল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রায়ই এ ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাকে।

“আমি গত তিন মাসে ৬০টির মতো রাইড নিয়েছি। কিন্তু বেশিরভাগ চালকই গন্তব্য জিজ্ঞেস করে। তাদের পছন্দমতো হলে যায়, নইলে ক্যান্সেল করে দেয়। আবার অনেকে আসার কথা বলে আর আসে না। কোনো চালক পরপর তিনবার রাইড ক্যান্সেল করলে তার আইডি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল করে দেওয়া উচিত।”

নীতিমালার ৩ (ক) ধারায় ট্রাফিক আইন মেনে চলার কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানেন না চালকরা। ট্রাফিক আইন না মেনে দ্রুতগতিতে বেপরোয়া চালানোর অভিযোগ করেছেন অনেকেই।

পাঠাওয়ের  রাইড শেয়ারিংয়ে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে সম্প্রতি দুর্ঘটনায় পড়েন মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা এক তরুণী, যিনি গায়ে হলুদের ব্যস্ততায় রাস্তার সময় কমাতে এই সেবা নিতে চেয়েছিলেন।

হতাশার সুরে ওই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেক চালক খুব বাজেভাবে বাইক চালায়। গত মাসে আমার গায়ে হলুদের দিন পাঠাওয়ের বাইকে চড়ে বাসায় যাচ্ছিলাম। ড্রাইভার এতো জোরে বাইক চালাচ্ছিল যে, রাস্তার অনেকটা অংশ ভাঙা থাকলেও সেটা সে দেখেনি।

“শেষ মুহূর্তে দেখে ব্রেক কষলে বাইক উল্টে যায়। পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা পাই আমি। ড্রাইভার আরও বেশি আঘাত পাওয়ায় গাড়ি নিয়ে আর যেতে পারেনি।”

সম্প্রতি মহাখালী থেকে বারিধারা যাওয়ার পথে প্রায়ই ফুটপাতে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দিচ্ছিলেন চালক জসিম উদ্দিন। এভাবে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব সময় এভাবে যান না।

“রাস্তায় জ্যাম থাকলে ফুটপাত দিয়া যাই। নইলে রাস্তায়ই থাকি,” বলেন তিনি।

নীতিমালার ৩ (গ) ধারায় যাত্রীদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণের বাধ্যবাধতা আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু অর্থ দিয়ে এই সেবা নিতে গিয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ, যৌন হয়রানির অভিযোগও পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি পাঠাওয়ের একটি মোটরসাইকেলে চড়ার পর এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয় বলে অভিযোগ করেন মহাখালীর একটি প্রতিষ্ঠানের একজন নারী কর্মী।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগারগাঁও থেকে মহাখালীর কর্মস্থলে আসছিলেন তিনি।

“ওই বাইকের চালক খুবই গাঁ ঘেষে বসছিল। সামনে বসায় জায়গা থাকলেও সে এটা করছিল, যা খুব বেশি অস্বস্তিকর।”

নীতিমালার ক অনুচ্ছেদের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, নির্ধারিত স্ট্যান্ড, অনুমোদিত পার্কিংয়ের জায়গা ছাড়া যাত্রী তোলার জন্য সড়কের যেখানে সেখানে গাড়ি রাখা যাবে না।

কিন্তু রাজধানীর গুলশান, বনানীবাজার, মহাখালী, কারওয়ানবাজার, পান্থপথসহ বিভিন্ন সড়কে মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা যায়। অনেকে যাত্রীদের ডাকাডাকিও করেন।

এর মধ্যে একদিন কুড়িল বিশ্বরোডে গিয়ে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক লোকজনের কাছে গন্তব্য জানতে চাইছেন। লোকজনকে ডাকাডাকির কারণ জানতে চাইলে তুহিন নামে ওই চালক বলেন, দুপুরে অ্যাপে কল কম থাকলে ডেকে যাত্রী নেন।

“অ্যাপ আর চুক্তিতে দুইভাবেই যাই। এখন কল নাই। বসে আছি অনেকক্ষণ ধরে। যদি কাউকে পাই এজন্য ডাকছি।”

হামিম নামে আরেক চালক বলেন, বাইকার বেশি এবং ট্রিপ কম হওয়ায় অনেকেই এটা করেন।

“যারা শুধু মোটরসাইকেল চালিয়ে রোজগার করতে আসছে তারা এটা করে। অফিস টাইম ছাড়া অ্যাপে রিকোয়েস্ট কম আসে। তখনই ডেকে ডেকে যাত্রী নেওয়ার চেষ্টা করে।”

এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে রাইড শেয়ারিং কোম্পানি ওভাই-এর সহকারী ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শাফায়েত রেজা বলেন, চালকদের নিয়মনীতি মেনে চলার ক্ষেত্রে তারা বেশ কঠোর।

“যদি রাইডের সময় এ ধরনের আচরণ কেউ করে তাহলে অ্যাপের এসওএস বাটনে নোটিফিকেশন দেবে। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিতে পারব। প্রথমে যেটা করি একটা ফোন কল করে জিনিসটা ভেরিফাই করতে পারি।”

তিনি বলেন, “আমরা অনেক যাচাই-বাছাই করে রাইডার নেই। এ কারণে আইন অমান্য করার ঘটনা খুব একটা ঘটে না। তবে প্রোমোকোড নিয়ে মাঝখানে ঝামেলা হয়েছিল। কিন্তু সেটা এখন আর তেমন হয় না। আমরা অভিযোগ পাই না।”

যাত্রীদের অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় বলে দাবি করেছে আরেক কোম্পানি পাঠাও।

অভিযোগ নিয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ইমেইলে কোম্পানিটি বলে, “যাত্রীদের এসব অভিযোগ আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখি। প্রমাণ পেলে অভিযুক্ত রাইডারদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। পুনরায় একই অভিযোগ পাওয়া গেলে স্থায়ীভাবে রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়।

“খারাপ রেটিংপ্রাপ্ত চালকদের কীভাবে আরো নিবিড় পর্যবেক্ষণের অধীনে আনা যায় এবং যাত্রীদের আরও উন্নত সেবা প্রদান করা যায়, সে বিষয়ে আমরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি।”

অপরদিকে রাইড শেয়ারিং কোম্পানি উবার বলছে, “যাত্রী ও চালকদের নিরাপত্তা আমাদের কাছে প্রথম। এজন্য আমরা উবার পার্টনারদের দেশের প্রচলিত আইন, সড়ক নিরাপত্তার বিষয়গুলো মেনে চলার অনুরোধ করি।”

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সহজ ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা এম কাদিরের মোবাইলে বেশ  কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। মোবাইলে বার্তা পাঠালেও কোনো জবাব দেননি তিনি।

রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিআরটিএর পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, “তারা নীতিমালা মানতে বাধ্য। আইন মানবে বলেই এই নীতিমালার আওতায় ফি দিয়ে সে তালিকাভুক্তির আবেদন করেছে। কিন্তু তাদেরকে এখনও আমরা রেজিস্ট্রেশন দেইনি। ফলে তাদের বিরুদ্ধে যে এনফোর্স করব, তাকে জেল জরিমানার আওতায় আনব, সেটা করা যাচ্ছে না।”

বিআরটিএ রাইড শেয়ারিং নীতিমালার ছ (১) ধারায় বলা হয়েছে, শর্ত ভঙ্গ করে কোনো রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করলে সংশ্লিষ্ট রাইড শেয়ারিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধসহ দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

ছ (২) ধারা অনুযায়ী, এ নীতিমালা কোনো শর্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বা এ নীতিমালা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত নির্দেশনার কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো রাইড শেয়ারিং মোটরযান মালিক বা চালক কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করলে সংশ্লিষ্ট রাইড শেয়ারিং এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট বাতিল ও মোটরযানের রাইড শেয়ারিং কার্যক্রম বন্ধ করাসহ দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।