নতুন সরকারকে সুশাসনে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ

নতুন সরকার ও সংসদকে সুশাসন ও দুর্নীতির রোধের বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ এসেছে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Jan 2019, 06:11 PM
Updated : 1 Jan 2019, 10:53 PM

একাদশ সংসদ নির্বাচনের দুদিন পর মঙ্গলবার রাতে ঢাকায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে ‘কেমন বাংলাদেশ চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এই পরামর্শ আসে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ও ডয়চে ভেলে’র যৌথ আয়োজনে ওই আলোচনায় সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির বলেন, “সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমি আশা করব, সুশাসন প্রক্রিয়া, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া ও দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে।”

সংসদে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সংসদে উপস্থিতির সময় ৯০ দিন থেকে কমিয়ে ৩০ দিন করার পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির এই চেয়ারম্যান।

স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা সৃষ্টির জন্য তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ ব্যাপক হারে করার পরামর্শ দিয়ে সাবেক তথ্য কমিশনার জমির বলেন, “যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন- তার নিজের, স্ত্রী, সন্তান, স্বামী, ভাই, বাবা-মায়ের সম্পত্তির হিসাব অনলাইনে থাকবে। তাহলে তিনি সম্পদ অর্জন করছেন কীভাবে এবং আয় কর দিচ্ছেন কি না, এসব বিষয় বেরিয়ে আসবে।”

ডিবিসির প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম

সুশাসন ও দুর্নীতি রোধের পরামর্শ দিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসির প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, “জনগণকে দেওয়া প্রত্যেকটি প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন আমি নাগরিক হিসাবে চাই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক কাঠামা সামগ্রিকভাবে সব উন্নয়নের মাত্রায় এগিয়েছে। এখন মানুষের মনে সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত একটা ব্যবস্থাপনা তৈরি করা এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে।

“যার মধ্য দিয়ে আমাদের এই আলোচনা করতে হবে না, নির্বাচন কমিশন ভালো, না তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভালো। আমরা এমন একটি পদ্ধতি আশা করব, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রতিষ্ঠিত করে যাবেন- আগামী দিনে যারা নেতৃত্বে আসবেন গণতান্ত্রিক এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না।”

ডয়চে ভেলের সাংবাদিক যোবায়ের আহমেদের সঞ্চালনায় আলোচনা অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেন, “আমি যারা এমপি হয়েছেন তিনি কোনো ব্যক্তির তোষামোদ করবেন না। সত্য কথাগুলো অকপটে বলতে হবে। সংসদে জনগণের কথাগুলো বলতে হবে। সংসদে গিয়ে আমি শুধু স্তুতি করব, কোনো বিষয় নিয়ে… তা না করে জনগণের চাহিদাগুলো তুলে ধরতে হবে।”

সংসদ সদস্য প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড ঠিক করার আহ্বানও জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই সিন্ডিকেট সদস্য।

তিনি বলেন, “জনগণের প্রয়োজনগুলো, তাদের চাহিদাগুলো এবং প্রতিষ্ঠানগুলো ফাংশনিং করছে কি না- সে জিনিসগুলোর সুসমালোচনা করতে হবে। এবং একই সঙ্গে সমালোচনার যে লিমিটেশনস আছে সেগুলোও সংসদে উত্থাপন করতে হবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশে মোটাদাগে চার-পাঁচটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আছে। নতুন সরকার সেগুলো যত দ্রুত সমাধান করবেন, ততই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।”

সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির

নির্বাচনে যে ২২টি কেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত হয়েছে সেগুলোর তদন্ত করে নির্বাচনি ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করার পরামর্শ আলোচনা অনুষ্ঠানে দেন মোহাম্মদ জমির।

তিনি বলেন, “নির্বাচন নিয়ে ওআইসি-সার্কসহ অনেকে যা বলেছে, তা এক কথায় এই রকম- ভোটাররা ভোট দিয়েছে বাধা ছাড়া।

“এখন আমাদের নির্বাচন কমিশন, তাদের উচিত হবে, ২০-২১টার মত অভিযোগ এসেছে, ২২টি কেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। তাদের এখন তদন্ত করতে হবে, আসলে কী ঘটেছিল। খুব সুষ্ঠুভাবে অনুসন্ধান করে বের করা উচিত যে, কারা কারা কি করেছে, না করেছে।

কোনো ক্ষেত্রে যদি পুলিশ হস্তক্ষেপ করে থাকে, সেটাও বের করার পরামর্শ দেন তিনি।

পোলিং এজেন্ট দিতে না পারার বিষয়ে প্রার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার পরামর্শ দিয়ে জমির বলেন, “তুমি নির্বাচনে আসবা, তোমার পোলিং এজেন্ট কেন থাকবে না, ওটা ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা উচিত।”

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মঈনুল ইসলাম বলেন, “নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিদের জন্য সমান সুযোগ থাকবে। কিন্তু এমনও দেখা গেছে, একজন এমপি ‍প্রার্থীর স্পিডবোটে আছেন ৪-৫জন কর্মী নিয়ে। তাদেরকে ধরে নিয়ে গেল- উনি বলছিলেন একজন থাকার জন্য। ভোটের আগে জনগণ ভয় পেয়েছে কি-না- সেটা থাকতে হবে।

“সক্ষমতার জায়গা মানে এটা না, আমি কত শতাংশ ভোট নিয়ে গেলাম। এর মধ্যে দেখতে হবে, আমি যাকে পছন্দ করছি, তাকে যৌক্তিকভাবে পছন্দ করছি না “

ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছিল মন্তব্য করে মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, “আগের দিনও তার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ চেয়েছেন। আগের দিনও তারা বলেছেন, কয়েক ঘণ্টা পর জানাবেন- নির্বাচনে থাকবেন কি না।

“জনগণ যখন জানে, একটি দল থাকবে নির্বাচনে নিশ্চিতভাবে, আর আরেকটি দল জানেই না তারা নির্বাচনে থাকবে কি না, তখন সে দলের পোলিং এজেন্ট থাকে না। কর্মীরা মাঠে যান না।”

সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, দলনেতা যদি না থাকেন। তাহলে নির্বাচনের মতো দলগত পরীক্ষায় যদি ভালো না করেন, সেটা হবে না।

“দলনেতা না থাকার কারণে দলীয় যে মুখ্য সিদ্ধান্তগুলো কোনো স্ট্রিক্ট বা টপ লাইন তাদের মধ্যে ছিল না। আমরা কি নির্বাচনে যাব? আমরা কি ব্যক্তিগতভাবে হারব-জিতব? দলনেতা না থাকায় একটা সঙ্কট ছিল।”

বিএনপির পোলিং এজেন্ট না থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নে মঈনুল ইসলাম বলেন, “আসলে প্রার্থীরা কি জনগণকে সম্পৃক্ত করতে চায়নি? নাকি সত্যিকার অর্থে বাধাগ্রস্ত হয়েছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মঈনুল ইসলাম

“দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, সেটা প্রমাণ করে দেওয়ার সুযোগ ছিল। ভবিষ্যতে কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাবে, যে দলীয় সরকারের অধীনে আসলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব? অনেক প্রার্থী মারধরের শিকার হয়েছেন। কিছু তথ্য মিডিয়াতে এসেছে, কিছু তথ্য এসেছে- আমি নাগরিকদের সুষ্ঠু পরিবেশ দিতে পেরেছি কি-না? নির্বাচন কমিশন যদি আন্তরিক হতো, তাহলে এই প্রশ্নগুলো উঠত না।”

তবে সাংবাদিক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, “মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যও ছিল- দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না এটাই প্রমাণিত হয়েছে। আমরা তাদের বক্তব্য ও তৎপরতা দেখলে মনে হয়, তারা এই প্রমাণ করার জন্য মাঠে নেমেছিলেন। তার মানে এটা প্রমাণিত হয়, প্রশ্নবিদ্ধ করার তৎপরতা নিয়ে যারা ছিলেন, তারা সফল হয়েছে তাদের কাজে।”

বিএনপি জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত না করতে পারার প্রসঙ্গ তুলে ধরে সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, “বিএনপি গত ১০ বছরে যে আন্দোলন করেছে, হয়তো দলীয় নেতাদের মুক্তি জন্য। আমাদের সামাজিক ইস্যুতে তারা নামেনি। নিরাপদ সড়ক নিয়ে তারা কি কখনো ভেবেছে?”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল আলম চৌধুরী

বিএনপি নেতাদের শপথ না নেওয়া জনগণের জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখন হয়ত তারা বলেছে, আমরা শপথ নেব না। তাহলে মানুষের কথা বলার জায়গাটা কোথায়? সাতজন জিতেন বা ৭০জন জিতেন। আমি মনে করি, ইট উড বি এ ব্লান্ডার।

“যদি ৫-৭ জনের একজনও সংসদে না যায়… কারণ সংসদে দাঁড়িয়ে যদি আপনি একটি কথা বলেন, সেটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।”

নির্বাচনের দিন সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল উল্লেখ করে মোহাম্মদ জমির বলেন, “জনগণের সার্বিক প্রত্যাশা, যিনিই সরকার গঠন করেন, যিনি সরকারে থাকেন, যেই গঠন করেন না কেন- তাদের তিনটা বলয় থাকবে- নিরাপত্তার বলয়, তাদের চলাচলে অসুবিধা হবে না এবং সব জায়গা একটা দায়বদ্ধতা থাকবে।

অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে, এই নির্বাচনটা একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন। যদি আমি সরলীকরণ করি। এই নির্বাচনের কিছু গুণগত দিক রয়েছে, কিছু গুণগত দিকে অবক্ষয় রয়েছে।

“নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ যথার্থভাবে করেছে কি-না। কিছু চিত্র গণমাধ্যমেও এসেছে- সেটা নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক করবে।”

সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, “শতভাগ অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন পৃথিবীর কোথাও দেখানো যাবে না। কারণ এটা একটা মহাযজ্ঞ। ৪০ হাজারের বেশি কেন্দ্রের মাত্র ২২টি কেন্দ্রে টুকটাক ঘটনা ঘটেছে। সেখানে নির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে, কারণ গোলযোগ হয়েছে। ৪০ হাজারের তুলনায় ২২টি যদি ধরি, তাহলে পার্সেন্টেজ খুবই নগণ্য।

“তার মানে ভোটাররা ঠিকমত ভোট দিতে পেরেছে, গণমাধ্যম সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করেছে। সে কারণে যে কোনো বিচারে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলা যেতে পারে। সেটি হয়তো পার্সেন্টেজ দিয়ে মাপা যাবে না।”