এবার সংসদে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে

এবার ভোটের লড়াইয়ে অংশ নেওয়া এবং সরাসরি জিতে আসা নারী সংসদ সদস্য সংখ্যা অতীতের যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে বেশি হয়েছে। এর সঙ্গে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন মিলিয়ে জাতীয় সংসদের ইতিহাসে এবারই প্রথম সবচেয়ে বেশি নারী প্রতিনিধি দেখা যাবে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Jan 2019, 05:51 PM
Updated : 1 Jan 2019, 05:56 PM

রোববার  অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ২২ জন নারী।  এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৯ জনই নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হয়েছেন। আর জাতীয় পার্টি থেকে দুজন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন একজন।

লাঙল প্রতীকে জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান রওশান এরশাদ ময়মনসিংহ-৪ আসন থেকে  টানা দ্বিতীয়বার সাংসদ হলেন। 

এর আগে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৯ জন প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন, ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৬ প্রার্থীর মধ্যে আটজন, সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ৩৮জন প্রার্থীর মধ্যে ছয়জন, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৯ জন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৮ জন নারী প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন।

এবার এক হাজার ৮৪৮ জন প্রার্থীর মধ্যে স্বতন্ত্রসহ ৬৯টি আসনে চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন ৬৮ জন নারী প্রার্থী; আনুপাতিক হারে তা কম হলেও এই সংখ্যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

ভোটের লড়াইয়ে থাকা নারী প্রার্থীদের মধ্যে ৩২ দশমিক ৩৫ শতাংশ নারী নির্বাচিত হয়েছেন। আর ৩০০ আসনের মধ্যে ২২টি আসনে নারীরা নির্বাচিত হওয়ায় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছেন সাত দশমিক ৩৪ শতাংশ নারী।  

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী নারীরা হলেন

গোপালগঞ্জ-৩ : শেখ হাসিনা (আওয়ামী লীগ)

রংপুর-৬ : শিরীন শারমিন চৌধুরী (আওয়ামী লীগ)

ফরিদপুর-২ : সাজেদা চৌধুরী (আওয়ামী লীগ)

ফেনী-১ : শিরীন আখতার (জাসদ)

বরিশাল-৬ : নাসরিন জাহান রতনা (জাতীয় পার্টি)

ঢাকা-১৮ : সাহারা খাতুন (আওয়ামী লীগ)

গাজীপুর-৫ : মেহের আফরোজ চুমকি (আওয়ামী লীগ)

মানিকগঞ্জ-২ : মমতাজ বেগম (আওয়ামী লীগ)

খুলনা-৩ : মন্নুজান সুফিয়ান (আওয়ামী লীগ)

মুন্সিগঞ্জ-২ : সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি (আওয়ামী লীগ)

গাইবান্ধা-২ : মাহাবুব আরা বেগম গিনি (আওয়ামী লীগ)

সুনামগঞ্জ-২ : জয়া সেনগুপ্ত (আওয়ামী লীগ)

বাগেরহাট-৩ : হাবিবুন নাহার (আওয়ামী লীগ)

কুমিল্লা-২ : সেলিমা আহমাদ মেরী (আওয়ামী লীগ)

কক্সবাজার-৪ : শাহিনা আক্তার চৌধুরী (আওয়ামী লীগ)

শেরপুর-২ : মতিয়া চৌধুরী (আওয়ামী লীগ)

ময়মনসিংহ-৪ : রওশন এরশাদ (জাতীয় পার্টি)

চাঁদপুর-৩ : দীপু মনি (আওয়ামী লীগ)

গাজীপুর-৪ : সিমিন হোসেন রিমি (আওয়ামী লীগ)

নেত্রকোনা-৪ : রেবেকা মমিন (আওয়ামী লীগ)

যশোর-৬ : ইসমাত আরা সাদেক (আওয়ামী লীগ)

নোয়াখালী-৬ : আয়েশা ফেরদাউস (আওয়ামী লীগ)

নির্বাচিতদের মধ্যে কুমিল্লা-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নারী উদ্যোক্তা ও অসলো বিজনেস শান্তি পুরস্কারজয়ী সেলিমা আহমাদ এবং কক্সবাজার-৪ আসনে আওয়ামী লীগের বিতর্কিত সাংসদ আবদুর রহমান বদির স্ত্রী শাহীনা আকতার চৌধুরী নতুন মুখ হিসেবে এসেছেন। স্বামী মনোনয়ন না পাওয়ায় তিনি নির্বাচন করেন।

এর বাইরে যারা  নির্বাচিত হয়েছেন তাদের সবাই দশম সংসদে ছিলেন। এদের মধ্যে শিল্পী মমতাজ সংরক্ষিত নারী সাংসদ ছিলেন। জয় সেনগুপ্ত স্বামী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর ওই আসনে উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে আসেন। হাবিবুন নাহারও দশম সংসদে আসেন বাগেরহাট-৩ আসনে উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়ে, স্বামী তালুকদার আব্দুল খালেক খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হতে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করলে সেখানে উপ-নির্বাচন হয়।

সংসদ সদস্য নির্বাচিত রওশন এরশাদ দশম সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা

সংসদে নারীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বেশি হলেও এ সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন নারী নেত্রীরা। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাকেই বড় করে দেখছেন তারা।

নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বিডিনিউজ টেয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নারীদের সংখ্যাটা বেড়েছে, এটি ইতিবাচক কিন্তু এ সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি বাড়া উচিত। কারণ নারীরা জনসংখ্যার অর্ধেক। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে কর্মসূচি নিতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে।”

২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বিধিমালা প্রণয়নের সময় ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্বের শর্ত দিয়েছিল। তবে গত এক দশকেও কোনো দল তার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারেনি।  

দুই বছর জরুরি অবস্থার সময় বাদ দিলে গত দুই যুগের বেশি সময় দেশে বাংলাদেশের সরকার ও সংসদে বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। গত দুটি সংসদে স্পিকারের দায়িত্বেও আছেন একজন নারী। কিন্তু আইনসভায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে খুব ধীর গতিতে।

নারী উদ্যোক্তা সেলিমা আহমাদ কুমিল্লার একটি আসনে নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছেন

এ প্রেক্ষিতে এক তৃতীয়াংশ আসনে নারী প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল নারী অধিকার সংগঠনগুলো।

সেই দাবি পূরণ হয়নি বলে জানিয়ে সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, “সব দলের জন্যই আমাদের এ দাবি ছিল, সেটা পূরণ হয়নি। আর জাতিসংঘের অঙ্গীকার, সংসদে এক তৃতীয়াংশ নারী সংসদ সদস্য থাকতে হবে, সেদিক দিয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে।

“আমরা তো এখনও পিছিয়ে, এখন ভালো করলেও আরও অনেক ভালো করতে হবে। নারীরা সিদ্ধান্তগ্রহণ পর্যায়ে যেতে না পারলে নারীদের জন্য কাজ করাটা কঠিন হয়ে যায়।”

ফেনী-১ আসন থেকে নির্বাচিত জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে বলেন, “সংসদে আমরা অর্ধেক থাকতে চাই, কিন্তু বাস্তব অবস্থায় তা খুবই কঠিন। দলের ভেতরে নারীকে কতটুকু গুরুত্ব দিয়ে দেখছে, নারীর অর্থনৈতিক দিকটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

“এছাড়াও তার প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষ প্রার্থী তাকে গুরুত্বই দেয় না, কর্মী ‘মোবিলাইজ’ করার ক্ষেত্রেও অনেক সঙ্কট তৈরি হয়।”

প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন আব্দুর রহমান বদির স্ত্রী শাহীনা আক্তার

নারীদের পিছিয়ে থাকার জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এবং এর চিন্তা-চেতনাকে দায়ী করে তিনি  বলেন, “পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সংগঠনের ভেতরেও বিরাজমান। সেজন্য প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে কাবু হয়ে যাচ্ছে নারীরা।”

রাজনৈতিক দলগুলোর নারীকে সমান সুযোগ ও গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে  নারীরা এগিয়ে আসতে পারবে বলে মনে করেন এই নারী সাংসদ।

বর্তমানে সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে, যারা পরোক্ষ ভোটে আইনসভায় যান।

পুরনো খবর