বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন পদ্ধতির মূল্যায়নে যারা এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে, তারা ‘প্রকৃত মেধাবী’।
এসএসসি ও এইচএসসি পর অষ্টমের সমাপনীতেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে কুমিল্লা বোর্ড। সিলেট বোর্ডে ফল খারাপ হওয়ার জন্য গণিতের ‘কঠিন প্রশ্ন’কে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষায় এবার পাস করেছে ৮৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থী; ৬৮ হাজার ৯৫ জন পেয়েছে জিপিএ-৫।
গতবার এ পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ; এক লাখ ৯১ হাজার ৬২৮ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল।
অর্থাৎ, পাসের হার বাড়লেও এবার পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা গতবারের তুলনায় এক তৃতীয়াংশের মত।
এবারের বিস্তারিত ফলাফল প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জিপিএ-৫ কমার ব্যাখ্যায় বলেন, “আগে অষ্টমের শিক্ষার্থীদের চতুর্থ বিষয়ের নম্বর ধরেই ফলাফল হিসাব করা হত। মূল্যায়ন পদ্ধতির ধারাবাহিক পরিবর্তনের অংশ হিসেবে এবার তা করা হয়নি।
“এ কারণেই জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। চতুর্থ বিষয়ের নম্বর যোগ করলে দেখা যাবে জিপিএ ফাইভ আবার বেড়ে গেছে।”
জেএসসি-জেডিসিতে আগে বাংলা ও ইংরেজির দুটি করে পত্রে ১৫০ করে নম্বরের পরীক্ষা হলেও এবার বাংলা ও ইংরেজিতে আলাদা পত্র ছিল না। বাংলা ও ইংরেজিতে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়েছে।
তাছাড়া এবার জেএসসি-জেডিসির চতুর্থ বিষয়ের ওপর চূড়ান্ত কোনো পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করে সেই নম্বর মার্কশিটে রাখা হলেও গ্রেডিং নির্ধারণে তা আমলে নেওয়া হয়নি।
নাহিদ বলেন, “আমরা আস্তে আস্তে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং উন্নতমানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিবেচনায় নিয়ে মূল্যায়নে যাচ্ছি বলে আপাত মনে হবে জিপিএ-৫ কমে গেছে, আসলে কমেনি।”
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মু. জিয়াউল হকও সারা দেশের ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সার্বিক ফল ভালো এবং মানসম্মত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ভালো পরীক্ষা দিয়েছে।”
ঐচ্ছিক বিষয়ের নম্বর গ্রেডিং নির্ধারণে যোগ করা না হলেও তা নম্বরপত্রে রাখা হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক জিয়াউল।
তিনি বলেন, “গতবছর সকল বিষয়ে যত শিক্ষার্থী জিপিএ-৫, অর্থাৎ তথাকথিত গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছিল, এবারও কিন্তু ওই সংখ্যাটা কাছাকাছি। প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থী যারা, এখন তাদের খুঁজে বের করার পথ তৈরি হয়েছে। যারা জিপিএ-৫ পায়নি, তারাও বুঝতে পারবে পরীক্ষার ফল আরেকটু ভালো করতে কী করা দরকার।”
আগে চতুর্থ বিষয়ের গ্রেডিং পয়েন্টের ৫ নম্বর থেকে পাস মার্কের ২ বাদ দিয়ে সর্বোচ্চ ৩ নম্বর জিপিএ হিসাব করার সময় যোগ করার সুযোগ ছিল।
চতুর্থ বিষয়ের নম্বর যোগ না হওয়ার পরেও যারা পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পেয়েছে তাদের একটু ভিন্নভাবেই মূল্যায়ন করছেন সিলেট বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুছ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এবার উত্তরপত্রের মানসম্মত মূল্যায়ন হয়েছে। সব বিষয়ে যারা পূর্ণ জিপিএ পেয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে এরাই প্রকৃত মেধাবী।”
দিনাজপুর বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবু বকর সিদ্দিকও মনে করেন, চতুর্থ বিষয়ের নম্বর যোগ না হওয়ার পরেও যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে তারা ‘সত্যিকারের মেধাবী’।
কোথায় কেমন ফলাফল
পাসের হার (%) | জিপিএ-৫ (জন) | বোর্ড | পাসের হার (%) | জিপিএ-৫ (জন) |
২০১৭ | ২০১৭ |
| ২০১৮ | ২০১৮ |
৮১.৬৬ | ৭৬,৮৪৮ | ঢাকা বোর্ড | ৮৩.১৯ | ২২,৩৩৪ |
৯৫.৫৪ | ৩৭,৬৩৩ | রাজশাহী | ৯৪.৫৭ | ১৪,৬৩৮ |
৬২.৮৩ | ৮,৮৭৫ | কুমিল্লা | ৮৬.৯৯ | ৩,৭৪২ |
৮৩.৪২ | ১৪,৬১২ | যশোর | ৮৪.৬১ | ৭,২৫৬ |
৮১.১৭ | ১০,৩১৫ | চট্টগ্রাম | ৮১.৫২ | ৫,২৩১ |
৯৬.৩২ | ৮,৪৩১ | বরিশাল | ৯৭.০৫ | ৪,৯০৬ |
৮৯.৪১ | ৭,৬২১ | সিলেট | ৭৯.৮২ | ১,৬৯৮ |
৮৮.৩৮ | ২০,০৬২ | দিনাজপুর | ৮১.৬৩ | ৬,৩০৩ |
৮৬.৮০ | ৭,২৩১ | মাদ্রাসা বোর্ড | ৮৯.০৪ | ১,৯৮৭ |
৮৩.৬৫ | ১,৯১,৬২৮ | মোট | ৮৫.৮৩ | ৬৮,০৯৫ |
ঢাকা বোর্ডে এবার গণিতে পাসের হার কিছুটা কম জানিয়ে অধ্যাপক জিয়াউল হক বলেন, কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরিয়তপুরে পাসের হার কিছুটা কম হলেও ঢাকা মহানগরীতে পাসের হার ৯৫ শতাংশের কাছাকাছি।
ঢাকা বোর্ডে জিপিএ-৫ পাওয়াদের অর্ধেকই মহানগরীর শিক্ষার্থী জানিয়ে বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, ঢাকায় ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ভালো শিক্ষক থাকায় শিক্ষার্থীরা ভালো ‘গাইডলাইন’ পায়।
ফল প্রকাশের সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ বলেন, “নির্বাচন সামনে রেখে পরিস্থিতিটা রাজনৈতিকভাবে একটু অন্য রকম ছিল, তার মধ্যে আমরা পরীক্ষা নিয়েছি। এই পরীক্ষা নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি বা গুজব হলেও প্রচার করেননি।
“শেষ দুটি পরীক্ষা (মাধ্যমিক ও অষ্টমের সমাপনী) দিয়ে যদি বিচার করেন, তাহলে যে অভিযোগ ছিল সেটা এখন আর ওইভাবে করার মত অবস্থা নেই।”
কুমিল্লা বোর্ডে এসএসসি ও এইচএসসিতে গতবছর ফল বিপর্যয় হলেও চলতি বছরের ফলাফলে সেই ধাক্কা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে দেখা গেছে। এরপর অষ্টমের সমাপনীতেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে কুমিল্লা বোর্ড। পাসের হার গতবারের ৬২ দশমিক ৮৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ হয়েছে।
কুমিল্লা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রুহুল আমিন ভূঁইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১৭ সালে পাবলিক পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের পর কয়েকটি কমিটি করে কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়।
“ওইবার ইংরেজি ও গণিতে ফল খারাপ হয়। আমরা গণিত ও ইংরেজি শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করি, সমস্যার কথা শুনে সমাধানে পদক্ষেপ নিই। তাদেরকে নিয়ে কর্মশালা করেছি। তারাও (শিক্ষক) বেশ কষ্ট করেছেন, এখন সবার পরিশ্রমের ফসল পাচ্ছি।”
কুমিল্লা বোর্ডের ফল অন্য বোর্ডের তুলনায় এবারও ‘খুব ভালো হয়নি’ মন্তব্য করে অধ্যাপক রুহুল আমিন বলেন, “আমরা আগের অবস্থানে ফিরে এসেছি মাত্র। তবে এবার কোনো বিষয়ে ঢালও ফেল নেই, তাই ভালো ফল হয়েছে।”
জেএসসি-জেডিসিতে ২০১৭ সালে কুমিল্লা বোর্ডে ফল বিপর্যয় হলেও ২০১৫ সালে ৯২ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৮৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল।
কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন ‘কঠিন’ হওয়ার পাশাপাশি সিলেট বোর্ডে গণিতে বেশি ফেল করায় পাশের হার গতবারের
৮৯ দশমিক ৪১ শতাংশ থেকে কমে এবার ৭৯ দশমিক ৮২ শতাংশ হয়েছে বলে মনে করেন এ বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুছ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সব বোর্ডেই আলাদা প্রশ্নে পরীক্ষা হয়েছে। আমাদের বোর্ডে গণিতের প্রশ্ন কঠিন হয়েছিল, তাই ফেল করেছে বেশি।”
অধ্যাপক কুদদ্দুছ জানান, সিলেট বোর্ড থেকে গণিতে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭১ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১ লাখ ২২ হাজার ৫৪৮ জন পাস করেছে। গণিতে পাসের হার ৮৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। গতবার এই বিষয়ে পাসের হার ছিল ৯৬ দশমিক ০৯ শতাংশ।
সিলেট বোর্ডে এবার ইংরেজিতে ৯৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে, গতবার ইংরেজি প্রথম পত্রে ৯৮ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রে ৯৪ দশমিক ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। এবার ইংরেজির দুই পত্র মিলিয়ে একটি পরীক্ষা হয়েছে।
পাসের হার কমে যাওয়ার জেএসসি পর্যায়ের শিক্ষকদের নিয়ে আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনার কথা জানান বোর্ড চেয়ারম্যান।
নির্বাচনী পরীক্ষায় ‘ঢালাওভাবে পাস করিয়ে’ শিক্ষার্থীদের মূল পরীক্ষায় বসানোও পাসের হার কমার একটি কারণ বলে মনে করেন অধ্যাপক কুদ্দুছ।
দিনাজপুর বোর্ডের পাসের হার গতবারের ৮৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ থেকে কমে এবার ৮১ দশমিক ৬৩ শতাংশ হওয়ায় ‘ফল বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নেওয়া’ হবে বলে জানান এ বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক।
তিনি বলেন, “কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটে বরাবরই পাসের হার কম থাকে। সাবেক ছিটমহল অঞ্চলেও শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করছি। প্রতিবার এক রকম প্রশ্ন হয় না, শিক্ষার্থীও এক রকম থাকে না। তাই পাসের হারে হেরফের হতেই পারে।”