বিজয়ের ৪৭ বছর

ফিরে এল বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ; নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তির দিন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2018, 06:14 PM
Updated : 16 Dec 2018, 09:13 AM

দুই যুগের পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল যে বাংলাদেশ, রোববার তার ৪৭ বছর পূর্তি উদযাপন করছে জাতি।

বিজয় দিবস উদযাপনে আলোর খেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভবনের দেয়ালে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবয়ব

বাঙালির এই বিজয় এসেছিল অনেক রক্ত ঝরিয়ে, শোষণ-বঞ্চনা আর যন্ত্রণার শেষে লাখো মানুষের আত্মাহুতি ও বাংলা মায়ের আত্মদানের বিনিময়ে।

৪৭ বছরের পথচলায় এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ দেশ আখ্যায়িত করে যারা অপমান করেছিল, সেই তাদের কণ্ঠেই এখন বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা। দারিদ্র্য আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। বিজয়ের এই ক্ষণে সমৃদ্ধির এই ধারা ধরে রাখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিজয় দিবস উপলক্ষে আলোকসজ্জা করা হয়েছে ঢাকার রাজউক ভবনে। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, “লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে দলমত নির্বিশেষে সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।

“মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরও বেশি অবদান রেখে দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ আগামীর পথে এগিয়ে নিতে আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”

এবার বিজয় দিবস ভিন্ন মাত্রা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায়, ১৪ দিনের মাথায় ভোটের মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশের নেতৃত্ব বেছে নেবে জনগণ। তবে নির্বাচন ঘিরে সহিংসতার শঙ্কা রয়েছে জনমনে, রয়েছে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে অনিশ্চয়তাও।

বিজয় দিবস উপলক্ষে ঢাকা দক্ষিণের নগর ভবন সাজানো হয়েছে আলোর সাজে। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

রাষ্ট্রপতির বাণীতেও তাই উঠে এসেছে নির্বাচনের প্রসঙ্গ: ভোট উৎসবের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের বিজয় সুদৃঢ় করার প্রত্যাশা জানিয়েছেন তিনি।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক প্রার্থীদের নির্বাচিত করে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি অব্যাহত রাখবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।

বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া বাণীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “আসুন দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করি, ২০১৮ সালের বিজয় দিবসে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার ।”

বিজয় দিবসে লাল সবুজ আলোয় আলোকিত সুপ্রিম কোর্ট ভবন। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিশ্বের পাঁচটি দেশের একটি বাংলাদেশ। উন্নয়নের ৯০ ভাগ কাজই নিজস্ব অর্থায়নে করছি।

“একটানা ১০ বছর আওয়ামী লীগ সরকারে থাকার কারণে তৃণমূলের জনগণ আজ উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আগামী প্রজন্ম পাবে সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ।”

২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্র্যমুক্ত মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের আগেই উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার শপথও এসেছে প্রধানমন্ত্রীর বাণীতে।

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও তা যে টিকবে না, তা আঁচ করেছিলেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক; তারপর নিপীড়ন-নির্যাতন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে প্রবল করে তোলে।

পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধিকারের চাওয়াকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালে অস্ত্রের মুখে রুদ্ধ করতে প্রয়াস চালিয়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষের উপর।

মতিঝিলের বিমান ভবনে বিজয় দিবসের আলোকসজ্জা। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই বাংলার মানুষ। ন্যায্য অধিকারের সশস্ত্র সেই সংগ্রামে সহায়তার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছিল প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।

এরপর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী; লাল সবুজ পতাকা ওড়ে স্বাধীন ভূমিতে, নতুন দেশে।

স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে জাতির জনককে হত্যার পর বাংলাদেশের উল্টো পথযাত্রায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা।

তবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। রাজনীতির পটপরিবর্তনের পর বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে সেই দোসরদের। বিচার হয়েছে তাদের, বাংলাদেশ তাদের ঝুঁলিয়েছে ফাঁসিকাষ্ঠে।

নানা কর্মসূচি

বিজয়ের ৪৭ বছর পূর্তিতে রোববার সরকারি-বেসরকারি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এ মাটির মুক্তির জন্য প্রাণ দেওয়া ৩০ লাখ শহীদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে দেশবাসী।

সরকারি-বেসরকারি সব ভবনে উড়ছে জাতীয় পতাকা, সাভার স্মৃতিসৌধসহ দেশের সব শহীদ বেদীগুলো ভরে উঠছে শ্রদ্ধার ফুলে।

বিজয় দিবস উপলক্ষে লাল সবুজ আলোয় আলোকিত সুপ্রিম কোর্ট ভবন। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয় সকালে রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে।

তার পরের কর্মসূচি আবর্তিত হতে থাকে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা শ্রদ্ধা জানান একাত্তরের বীর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে।

বাংলাদেশে নিয়োজিত বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

বিজয় দিবস উপলক্ষে আলোকসজ্জা করা হয়েছে ঢাকার রাজউক ভবনে। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

বিজয় দিবস উপলক্ষে ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায় সাজানো হয়েছে। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে  সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন  সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করেছে।

বিজয় দিবসে ঢাকা দক্ষিণের নগর ভবন সাজানো হয়েছে আলোর সাজে। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

এছাড়া মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে এদিন।

বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হচ্ছে।

এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, সরকারি শিশুসদনসহ ওই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে এদিন উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। দেশের সব শিশু পার্ক ও জাদুঘর রাখা হবে উন্মুক্ত।

মতিঝিলের বিমান ভবনে বিজয় দিবসের আলোকসজ্জা। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে আলোচনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে।

এ বছর ঢাকাস্থ জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে না, তবে দেশের সব জেলা ও উপজেলা সদরে কুচকাওয়াজ হচ্ছে।

বিজয় দিবস উপলক্ষে ঢাকার গাবতলী এলাকা থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত সড়কে যে কোনো ধরনের তোরণ, পোস্টার, ব্যানার এবং ফেস্টুন লাগানো থেকে বিরত থাকতে এবং রাস্তার দুই পাশে পর্যাপ্ত জায়গা পরিষ্কার রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।