এবার শিক্ষক হাসনা হেনার জন্য রাস্তায় শিক্ষার্থীরা

শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ‘প্ররোচণার’ অভিযোগে করা মামলায় কারাগারে থাকা শিক্ষক হাসনা হেনার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একদল শিক্ষার্থী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Dec 2018, 10:01 AM
Updated : 7 Dec 2018, 05:06 PM

শুক্রবার দুপুরে বেইলি রোডে স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে ‘ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রীবৃন্দ’ ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়।

দুপুর ২টা থেকে সাড়ে তিনটা ঘণ্টা ধরে চলা এই অবস্থান কর্মসূচিতে কিছু শিক্ষক ও অভিভাবকও যোগ দেন।

‘নিরপরাধ হাসনা হেনা আপার নিঃশর্ত মুক্তিসহ সসম্মানে ফিরিয়ে আনার দাবিতে’ এই অবস্থান বলে লেখা ছিল আন্দোলনকারীদের ব্যানারে।

আন্দোলনে অংশ নেওয়া রোজ নামে একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে উনি কোনোভাবে অরিত্রীর ঘটনায় দায়ী নন। উনার নাম কোনোভাবেই ঘটনার সঙ্গে আসেনি। উনি পরিস্থিতির শিকার বলে আমরা মনে করছি।”

এই অবস্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরাও অরিত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় ‘সুষ্ঠু বিচার চায়’ মন্তব্য করে রোজ বলেন, “কোনো শিক্ষিকা যাতে অন্যায়ভাবে হয়রানির শিকার না হন আমরা সেটাও চাচ্ছি।”

নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী গত সোমবার আত্মহত্যা করার পর থেকে উত্তেজনা চলছে রাজধানীর নামি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

অভিযোগ উঠেছে, পরীক্ষার সময় অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পাওয়ার পর তার বাবা-মাকে ডেকে নিয়ে ‘অপমান করেছিলেন’ অধ্যক্ষ। সে কারণে ওই কিশোরী আত্মহত্যা করেন।

তবে স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, অরিত্রী রোববার বার্ষিক পরীক্ষায় মোবাইল ফোনে নকলসহ ধরা পড়েছিলেন।

হাসনা হেনা ছিলেন অরিত্রীর ক্লাস টিচার। অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনার তার বাবা যে মামলা করেছিলেন সেখানে ভিকারুননিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও প্রভাতী শাখার প্রধান জিনাত আখতারের সঙ্গে তাকে আসামি করা হয়।

অরিত্রীর মৃত্যুর পর মঙ্গলবার থেকে টানা তিন দিন স্কুলের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে একদল শিক্ষার্থী ও অভিভাবক।

তাদের আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্তে অরিত্রীর আত্মহত্যায় প্ররোচনার জন্য ওই তিন শিক্ষককে চিহ্নিত করা হলে বুধবার তিন শিক্ষককে বরখাস্ত, তাদের এমপিও বাতিল করা হয়।

পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পুলিশ ও র‌্যাবকে চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই রাতেই হাসনা হেনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ঢাকার মহানগর হাকিম আবু সাঈদ বুধবার এই শিক্ষকের জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে নেওয়ার আদেশ দেন। তবে মামলার অপর দুই আসামিকে চারদিনেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

হাসনা হেনাকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে শুক্রবার স্কুলের সামনে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীরা যেসব প্ল্যাকার্ড দেখায়, তাতে লেখা ছিল-  ‘দোষীদের বিচার করতে গিয়ে নির্দোষের শাস্তি কেন?’, ‘অরিত্রী আমাদের বোন, শিক্ষক হাসনা হেনা আমাদের মা। নির্দোষের নিঃশর্ত মুক্তি চাই’, ‘শিক্ষকের হাতে হাতকড়া; একি আত্মহত্যার প্ররোচনা নয়?’

এ সময় ‘নির্দোষ মায়ের মুক্তি চাই, দিতে হবে’, ‘আমাদের মা হাসনা হেনা, তার স্থান জেলখানা না’সহ বিভিন্ন স্লোগানও দেয় তারা।

এই আন্দোলনের মধ্যে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে হাসনা হেনার মুক্তির দাবিতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে বিক্ষোভকারীরা।

এই কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া শিক্ষক সংগীতা ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা কলিগ হিসাবে আবেগের জায়গা থেকে তার মুক্তি চাই। শিক্ষার্থীরাও সেই আবেগ থেকে তাদের এই শিক্ষকের মুক্তি চাইছে।”

তিনি বলেন, শ্রেণিশিক্ষক হিসাবে কাউকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা হাসনা হেনার আছে কি না, বা ওই ঘটনায় তার দায় কতটুকু- সেটা দেখা দরকার।

হাসনা হেনার ক্ষেত্রে ‘পক্ষপাতিত্ব’ করা হয়েছে- এমন অভিযোগের জবাবে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর নেতা সংগীতা বলেন, “যেহেতু আইনগতভাবে এটা আগাচ্ছে। আইন দেখবে সেটা।”

অরিত্রীর আত্মহত্যার ক্ষেত্রে কেবল স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়ের পাশাপাশি পারিবারিক কোনো দায় আছে কি-না সেটাও  খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান অভিভাবক মোহাম্মদ মিনহাজ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্কুলে কিছুটা শাসন করা হয়, সেটা ছাত্র-ছাত্রীদের কথা মাথায় রেখেই। সেজন্য ছাত্র-ছাত্রী আত্মহত্যার দিকে যাবে, সেটা বলা যায় না। সে কারণে স্কুল কতটা দায়ী, আর পারিবারিক দায় কতটা- সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।”

কিছু শিক্ষক স্কুলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন এমন অভিযোগ করেন একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীর এই অভিভাবক।

তার মেয়ে এই প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে জানিয়ে মিনহাজ বলেন, “হাসনা হেনা ম্যাডামকে আমরা অনেক ভালো হিসাবে জানি। কিন্তু কিছু শিক্ষক আছেন যারা অভিভাবককে অভিভাবকই মনে করেন না। তারা মনে করেন, তারাই সব। যে কেউ ক্ষমতায় থাকলে সে তার ক্ষমতা দেখাতে চায়।”

বিকাল ৫টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নিতে আসেন ভিকারুননিসার গভর্নিং বডিতে শিক্ষক প্রতিনিধি মুশতারি সুলতানা।

তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, “উনি আমাদের ম্যাডাম, আমরা জানি উনি কেমন। তোমরাও কী কারণে এসেছো আমরা জানি। তোমরা আন্দোলন থেকে সরে আসো।”

তবে শিক্ষার্থীরা তার আশ্বাসে ক্ষান্ত না হয়ে শিক্ষক হাসনা হেনা মুক্তি পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।

পরে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে দিনের কর্মসূচি শেষ করার ঘোষণ দিয়ে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইকরা বলেন, “আমরা শনিবার সকাল ১১টা থেকে পুনরায় স্কুলের সামনে অবস্থান নেব। হাসনা হেনা ম্যাডাম মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবে আন্দোলন চলতে থাকবে।”