বাংলামোটরে নাটকীয়তার অবসান: বাবা আটক, ছেলের লাশ উদ্ধার

রাজধানীর বাংলামোটরের এক বাড়ি ঘিরে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তার অবসান ঘটেছে আড়াই বছরের একটি ছেলের লাশ ও চার বছরের একটি ছেলেকে জীবিত উদ্ধারের মধ্য দিয়ে; তাদের ‘মাদকাসক্ত’ বাবাকেও পুলিশ আটক করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2018, 08:58 AM
Updated : 5 Dec 2018, 03:06 PM

নুরুজ্জামান কাজল নামের মধ্যবয়সী ওই ব্যক্তি তার ছোট ছেলেকে ‘হত্যা করে’ আরেক ছেলেকে কোলে নিয়ে দা হাতে ঘরের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছেন খবর পেয়ে বুধবার সকালে ওই দোতলা বাড়ি ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

নানাভাবে বোঝানোর পর বেলা ২টার দিকে পুলিশ কৌশলে কাজলকে নিচ তলার সিঁড়ির কাছে নিয়ে এলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তার বড় ছেলে সুরায়েতকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেন। পরে ঘরের ভেতর থেকে ছোট ছেলে সাফায়াতের কাফনে জড়ানো লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।

স্বজনদের ভাষ্য, মাদকাসক্ত কাজলই তার ছোট ছেলেকে খুন করে বড় ছেলে জিম্মি করে বাড়ির ভেতরে ওই জিম্মি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন।

তবে আটক হওয়ার পর কাজল পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, সাফায়াতের মৃত্যু হয়েছে বৈদ্যুতিক শকে, তিনি তাকে হত্যা করেননি।

পরিস্থিতি থিতিয়ে আসার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার সাংবাদিকদের বলেন, “ছেলেটার গায়ে কোনো কাটা ছেঁড়া বা ক্ষত নজরে আসেনি। কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে আমরা বলতে পারছি না। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়ার আগে আমরা তার বাবা বা কাওকে দায়ী করছি না।”

কাজলদের পরিবার ওই এলাকার পুরনো বাসিন্দা। তার বাবা মনু মেম্বারও স্থানীয়ভাবে বেশ পরিচিত ব্যক্তি। কাজল নিজেই বাংলামোটর লিংক রোডের ১৬ নম্বর হোল্ডিংয়ের ওই বাড়ির মালিক।

কাজলের বাড়ির পাশে তার আত্মীয় স্বজন বেশ কয়েকজনের বাড়ি আছে। তবে মাদকাসক্তির কারণে কাজলের সঙ্গে অন্যদের সম্পর্কও ভালো ছিল না বলে তার বড় ভাই নুরুল হুদা উজ্জ্বলের ভাষ্য।

ওই বাড়ি ঘিরে নাটকীয়তার সূচনা হয় বুধবার সকাল ৮টার দিকে। কাজল স্থানীয় এক মাদ্রাসায় গিয়ে বলেন, তার ছোট ছেলে সাফায়েত বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেছে।

তিনি ছেলের মৃত্যুসংবাদ মাইকে ঘোষণা করতে অনুরোধ করেন এবং কোরআন খতমের জন্য মাদ্রাসা থেকে কাওকে বাসায় পাঠাতে বলেন।

তার কথায় মাদ্রাসা থেকে একজন ওই বাসায় গিয়ে দোয়া দুরুদ পড়তে শুরু করে। এদিকে কাজল তার ছেলেকে হত্যা করেছেন বলে এলাকায় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এই খবর পেয়ে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা বাংলামোটরের ওই বাড়িতে উপস্থিত হন। 

এদিকে বাবার হাতে ছেলে খুনের গুঞ্জনে কয়েকশ উৎসুক মানুষ ওই বাড়ির সামনে ভিড় করে। ছুটে আসেন সংবাদকর্মীরা।

এই পরিস্থিতিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন কাজল। ছেলেকে কোলে নিয়ে দা হাতে তিনি নেমে এসে সিঁড়ির কাছে কলাপসিবল গেইট আটকে দেন।

উজ্জ্বল এ সময় তার ভাইকে শান্ত করে সুরায়েতকে উদ্ধারের চেষ্টা করলেও তাতে লাভ হয়নি। গোয়েন্দা পুলিশের একজন সদস্য ওই বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করলে কাজলের দায়ের কোপে হাতে আঘাত পান।

উজ্জ্বল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ও (কাজল) সারাদিন নেশা করে, খায় আর ঘুমায়। এটা ওর নিজের বাড়ি। চাচার সাথে গত ঈদের আগেও মারামারি করেছে। এত দিন আমরা সহ্য করছি, পুলিশ আনি নাই, শুধু ওই বাচ্চাগুলোর কারণে। এখন বাচ্চাটাকেই মেরে ফেলছে। কাজলের মার খেয়ে ওর বৌ বাপের বাড়ি চলে গেছে। বাসায় দুই বাচ্চা নিয়ে ও থাকতো। আজকে এই কাণ্ড করল।”

ঘটনাস্থলে উপস্থিত গুলশান থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) মাহবুবর রহমান বেলা ১২টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, “একটি শিশু মারা গেছে এটা নিশ্চিত। তবে কীভাবে মারা গেছে এটা আমরা বলতে পারব না। আমরা তাকে দরজা থেকে শান্ত করার চেষ্টা করছি।”

শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, “ভেতরের অবস্থা এখনও নিশ্চিত না, বুঝতেই পারছেন। উনি উত্তেজিত অবস্থায় আছেন। ছোটো ছেলেটার কথা চিন্তা করে আমরা একটু সময় নিয়ে অভিযান চালাতে চাই।”

পরে পুলিশ কলাপসিবল গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে কাজলকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে। এক পর্যায়ে কাজলের চাচাতো ভাই সুলতান আহমেদ ভেতরে যান। কাজলকে বলা হয়, জোহারের নামাজের সময় হয়ে গেছে, সাফায়েতের জানাজা পড়াতে হবে।

এ কথায় কাজল সিঁড়ির কাছে নেমে এলে পুলিশ সদস্যরা তাকে ধরে ফেলেন এবং ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা সুরায়েতকে সরিয়ে নেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের সহকারী কমিশনার এহসানুল ফেরদৌস সাংবাদিকদের বলেন, “মৃত ছেলেটাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পাঠানো হয়েছে। বাবাকেও আটক করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, বৈদ্যুতিক শকে তার ছোট ছেলের মৃত্যু হয়েছে, তিনি মারেননি। আমরা বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখছি।”

কাজলের চাচাতো ভাই সুলতান আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ওর আপন ভাই, নিজের মা- তাদের সাথেও ওর যোগাযোগ নাই। ও মানসিকভাবে সুস্থ না। একটা লোক যদি মানসিকভাবে সুস্থ না হয় ওরে আপনে সময় দেবেন?” 

তিনি বলেন, দুপুরে কাজল তাকে ফোন করে ছেলেকে নিয়ে যেতে বলেন।

“বললো, ‘আপনে, ইমাম সাহেব আর মুয়াজ্জিন সাহেব আসেন’। আমি পুলিশের ওসি, ডিসি সাহেবরে বললাম। উনারাও আমারে যেতে বললেন। বলতে বললেন, বড় বাচ্চাটার জানাজা দেওয়া লাগবে, সেজন্য বের হইতে। আমরা গেলাম ভেতরে। বাইর করার সময় পুলিশ ধরছে। এখন আমরা পড়সি বিপদে। ও বলছে ‘তোরা পুলিশ ডাকছস, তোদের খবর আছে’।”

বাড়ির সামনেই তিনটি টাইলসের দোকান ভাড়া দেন কাজল। এর মধ্যে একটি দোকানের মালিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "কয়েকমাস ধরেই তো সে মানসিকভাবে অসুস্থ। মানুষরে হুমকি ধমকি দেয়।”