বেইলি রোডে স্কুলটির সামনে জড়ো হয়ে যেমন বিক্ষোভ করেছেন ও বিচার চেয়েছেন, তেমনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন তারা।
এর আগেও ছোট-খাট নানা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় শিক্ষকদের কাছ থেকে রূঢ় আচরণ পাওয়ার কথা বলেছেন এই অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষকদের খারাপ আচরণের শিকার হয়েছেন, এমন এক অভিভাবক সেই অভিজ্ঞতার কথা সাংবাদিকদের সামনে বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
অভিভাবকদের এভাবে স্কুলে ডেকে নিয়ে কটূ কথা শোনানো কোনোভাবেই মানা যায় না-বলেছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা।
শিক্ষকদের এসব বিষয় সামালের ক্ষেত্রে সংবেদনশীল হওয়া উচিত বলে মনে করেন অরিত্রীর এক সহপাঠীর বাবা আসাদুজ্জামান, যিনি নিজেও ঢাকার একটি স্কুলের শিক্ষক।
ভিকারুননিসার কিছু শিক্ষকের ব্যবহার শিক্ষকসুলভ নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আসাদুজ্জামান বলেন, “আমরা অভিভাবকরা তো আমাদের ছেলে-মেয়েদের জীবন দিয়েই ভালোবাসি। তারাও আমাদের ভালোবাসে। কেউ কারও অপমান সইতে পারি না।”
‘এ কেমন শিক্ষা, যার জন্য শিক্ষার্থীকে জীবন দিতে হয়?’, ’এ কি শুধু আত্মহত্যা?’, ‘আমরা আর অরিত্রী চাই না’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘সুইসাইড করা মানে প্রেমে ব্যর্থতা!’ প্রভৃতি লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ান বিক্ষুব্ধরা।
অধ্যক্ষের অপসারণসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভের সময় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মঙ্গলবারের পরীক্ষা পেছানোর দাবিও জানান অভিভাবকরা।
তাদের বক্তব্য ছিল, এই ক্লাসের শিক্ষার্থীরা তাদের একজনকে হারিয়েছে। শোক প্রকাশের জন্যও তো তাদের সময় দেওয়া উচিত। ওই ঘটনার পর তারা সেভাবে প্রস্তুতিরও সময় পায়নি।
তবে স্কুলের অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস সাংবাদিকদের বলেছেন, পরীক্ষার সূচি ঠিকই থাকবে। যারা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না, তাদেরটা পরে নেওয়া হবে।
তিনি একথা বললেও রাতে অভিভাবকদের একজন দিলারা চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সব পরীক্ষা ‘বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে’ শিক্ষার্থীরা।
দায়ীদের শাস্তি এবং অধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবিতে বুধবার সকাল ১০টায় আবারও কলেজের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করবেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।
সোমবার দুপুরে ঢাকার শান্তিনগরের বাসায় নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন অরিত্রী।
স্বজনদের দাবি, অরিত্রীর বাবা-মাকে ডেকে নিয়ে ‘অপমান করেছিলেন’ অধ্যক্ষ। সে কারণে ওই কিশোরী আত্মহত্যা করেছেন।
ক্ষোভ আর কান্না
অরিত্রীর ক্লাসেই পড়ে সাহানা বেগমের মেয়ে। মঙ্গলবার তিনিও ছিলেন বিক্ষুব্ধ অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে।
সে সময় সাংবাদিকদের কাছে শিক্ষকদের ‘অকথ্য গালিগালাজ’ ও রূঢ় আচরণের কথা বলার এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন সাহানা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বাচ্চা যদি কোনো খারাপ কাজ করে আমরা কি সেটাকে সমর্থন দিই? বাচ্চাদের সঙ্গে যে আচরণ করে সেটা বলার মতো না। অভিভাবকদেরও ডেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়।”
সাহানা বলেন, “নিজের অপরাধের জন্য বাবা-মায়ের অপমানের কারণেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে অরিত্রী। বাচ্চাদের বাবা-মায়েদের অপমান করে এমন স্কুল কোথাও নেই।”
সব শিক্ষক নয়, কিছু শিক্ষকের আচরণ অনেক রূঢ় মন্তব্য করে অভিভাবক আসাদুজ্জামান বলেন, “এ ধরনের শিক্ষকদের সংশোধন হওয়া দরকার। অরিত্রীর বাবা-মাকে অপমানের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
অরিত্রীর কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন দশম শ্রেণির সামিয়া হোসেন চৈতীও।
শিক্ষকদের খারাপ আচরণের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সবাই খারাপ না, অনেকের ব্যবহার খুব বাজে। অভিভাবকদের তো দোষ না, অভিভাবকরা প্রশ্রয়ও দেয় না। তাদেরকে কেন ডেকে এনে ঝাড়া হয়? আমরা চাই, এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটুক। স্কুলে যেন আমাদের মা-বাবাদের ডেকে অপমান করা না হয়।”
অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসের আচরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অভিভাবক দিলারা চৌধুরী; স্কুলের চতুর্থ ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে তার দুই মেয়ে।
দিলারা চৌধুরী বলেন, “আপনারা তো এতক্ষণ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন, কারও মুখ থেকে তার বিষয়ে ভালো কথা শুনেছেন? শোনার কথা না। কারণ উনি নানা ধরনের দুর্নীতিও করেন।”
গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক নাসির উদ্দিনের নাম উল্লেখ করেই অভিযোগ তোলেন কয়েকজন অভিভাবক।
তাদের একজন বলেন, “ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষা দিয়ে আসে আর দোয়া করে, আল্লাহ নাসির স্যারের কাছে যেন খাতা না যায়। কোচিং যারা করে না, তাদেরকে ফেল করে করিয়ে দেওয়া হয়। সে কারণে সবাই কোচিং করতে বাধ্য হয়।”
তোপের মুখে শিক্ষামন্ত্রী
উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে সকাল ১১টার দিকে বেইলি রোডে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে আসেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সেখানে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
বেলা ১২টার পর স্কুল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তোপের মুখে পড়েন মন্ত্রী। আন্দোলনরতরা প্রায় ১০ মিনিট তার গাড়ি আটকে রাখেন। এসময় ‘অরিত্রী হত্যার বিচার চাই, অধ্যক্ষের অপসারণ চাই’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ নানা স্লোগান দেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
এদিকে অরিত্রীর ঘটনায় জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস বলেন, “এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আমরা খুব মর্মাহত।”
এছাড়া শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা ঠেকাতে একটি জাতীয় নীতিমালা করতে অতিরিক্ত শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে দিয়েছে হাই কোর্ট। এই কমিটিকে নীতিমালা সংক্রান্ত এবং অরিত্রীর আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।