শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় আলোকচিত্রী আনোয়ারকে শেষ বিদায়

সহকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন খ্যাতিমান আলোকচিত্রী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Dec 2018, 12:08 PM
Updated : 3 Dec 2018, 12:08 PM

সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজার পর মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

এর আগে বেলা ১১টার দিকে আনোয়ার হোসেনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে সেখানে নাগরিক শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধি ও অধিকারকর্মীরা।

আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী মরিয়ম হোসেন এবং দুই ছেলে আকাশ হোসেন ও মেঘদূত হোসেন শহীদ মিনারে উপস্থিত ছিলেন এ সময়।

গত শনিবার পান্থপথের হোটেল ওলিও ড্রিম হেভেনের একটি কক্ষের দরজা ভেঙে পুলিশ ৭০ বছর বয়সী আনোয়ার হোসেনের লাশ উদ্ধার করে।

ফ্রান্সপ্রবাসী এই আলোকচিত্রী একটি প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ঢাকায় এসে ওই হোটেলে উঠেছিলেন। ঘুমের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে বলে ঘনিষ্ঠজনদের ধারণা।

সূর্যদিঘল বাড়ী, এমিলির গোয়েন্দা বাহিনী, লালসালু ও অন্যজীবন সিনেমার চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন পাঁচবার। বলা হয়, বাংলাদেশের আলোকচিত্রীদের পুরো একটি প্রজন্মকে নতুন পথের দিশা দিয়েছে তার কাজ।

তার কফিনে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংস্কৃতিক আন্দোলন কর্মী চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, “আনোয়ার হোসেন ফটোগ্রাফিতে এক অনন্য পুরুষ ছিলেন। তারুণ্যে তোলা তার ছবিগুলো দেখে আমরা বিস্মিত হই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, গণহত্যার ইতিহাস ও যুদ্ধের নৃশংসতার ইতিহাস তিনি যেভাবে আলোকচিত্রে তুলে ধরেছেন তা সম্ভবত আর কারো আলোকচিত্রে এতোটা ফুটে ওঠেনি।"

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, “আনোয়ার হোসেন আলোকচিত্রের মাধ্যমে এদেশে স্বাধীনতার ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনি এক উজ্জ্বল পুরুষ। তিনি তার কাজে প্রকৃতি ও পরিবেশের অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তিনি চলে গিয়েছেন আমাদের একা করে। যেখানেই তাকে দাফন করা হোক না কেন তিনি থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।”

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমি, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, দৃক ও পাঠশালা, মুভিয়ানা ফ্লিম সোসাইটি, বাংলাদেশ শর্ট স্লিম সোসাইটি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ ৭১, বাংলাদেশ ফটোগ্রাফি অ্যাসোসিয়েশন, জাতীয় কবিতা পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আনোয়ার হোসেনের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

১৯৪৮ সালের ৬ অক্টোবর পুরান ঢাকার আগানবাব দেউড়িতে আনোয়ার হোসেনের জন্ম। বাবা সিনেমার অফিসে কাজ করতেন বলে শৈশবেই রুপালি জগতের সঙ্গে তার পরিচয়। তখনই ছবি আকার শুরু। আর কলেজে উঠে স্কলারশিপের টাকা দিয়ে ৩০ টাকায় এক বন্ধুর কাছ থেকে আগফা ক্যামেরা কেনার ছবি তোলা শুরু করেন আনোয়ার।

নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আনোয়ার হোসেন ভর্তি হন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে। ১৯৭৪ সালে স্কলারশিপ নিয়ে সিনেমাটোগ্রাফির ওপর ডিপ্লোমা করতে যান ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। সেখানে বিখ্যাত জাপানি নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়ার সঙ্গে তার আলাপ হয়।

পুনে থেকে ফিরে মসিউদ্দিন শাকেরের 'সূর্য দীঘল বাড়ী' আর বাদল রহমানের 'এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী' চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন আনোয়ার হোসেন। সেই সময় পরিচয় হয় অভিনেত্রী ডলি আনোয়ারের সঙ্গে। ১৯৭৯ সালে বিয়ে হয় তাদের।

১৯৯১ সাথে ডলি আনোয়ারের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড ঘুরে প্যারিসে বসবাস শুরু করেন আনোয়ার। ১৯৯৬ সালে ফরাসি নাগরিক মরিয়মকে বিয়ে করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপানের আশাহি পেইন্টিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া আনোয়ার হোসেন ১৯৭৮ সালে কানাডায় কমনওলেথ আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় ছয়টি মেডেল জয় করেন। এরপর চার দশকে ৬০টির মত আন্তর্জাতিক পুরস্কার জমে এই আলোকচিত্রীর ঝুলিতে।