২১ বছর পরও শান্তির অন্বেষণ পাহাড়ে

পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর ২১ বছর পার হলেও নেতিবাচক মনোভাব, আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে পুরোপুরি শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে।

কামাল হোসেন তালুকদার, রাঙামাটি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Dec 2018, 07:02 PM
Updated : 2 Dec 2018, 07:05 PM

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য জনসংহতি সমিতি এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়। এর মধ্যে দিয়ে ওই অঞ্চলে প্রায় দুই যুগের সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটে। তিনমাস পর তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পণ করেন বিদ্রোহীরা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) পক্ষ থেকে সেই চুক্তিতে সই করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হলে তিনি হন এর চেয়ারম্যান। চুক্তির সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ; চুক্তির ২১ বছর পূর্তিতেও ক্ষমতায় রয়েছে একই দল।

চুক্তির ২১ বছর পূর্তির দিন রোববার রাঙামাটির জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  “শান্তিচুক্তির মোট ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে। ১৫টির আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে এবং নয়টি ধারা বাস্তবায়ন হওয়ার পথে।”

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন,  “শান্তিচুক্তির অবশিষ্ট অংশ বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হল তাদের (জেএসএস ও ইউপিডিএফ) নেতিবাচক মনোভাব।”

তার অভিযোগ, ‘আধিপত্য কমে যাবে’ বলে ওই দুটি সংগঠনের নেতারা পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন চান না।

১৯৯৭ সালে সরকারের পক্ষে চুক্তিতে সই করেছিলেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ

“পার্বত্য এলাকায় একটি মেডিকেল কলেজ ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যাতে না হয় সেজন্য বিরোধিতা করা হয়েছে। …সবকিছুতেই তাদের নেগেটিভ মনোভাব।”

রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশীদ দাবি করেন, শান্তি চুক্তির পর ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শান্তিতে বসবাস করছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পাকা করা হয়েছে। রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনেক বেড়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে।

তারপরও ‘ভুল বোঝাবুঝি ও বিশ্বাসের ঘাটতি’ থেকে যাওয়ায় চারটি আঞ্চলিক দলের মাঝেমধ্যে  অশান্তির সৃষ্টি হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সন্তু লারমা গত মাসের শেষেও ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেছেন, নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের নামে পাহাড়ে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরতদের ওপর দমনপীড়ন চালানো হচ্ছে।

তার অভিযোগ, শান্তি চুক্তিতে তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, মাধ্যমিক শিক্ষা, উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনও জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর করা হয়নি। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তদের স্ব-স্ব জায়গা-জমি দিয়ে তাদের যথাযথ পুনর্বাসনও করা হয়নি।

সরকারের ‘সদিচ্ছার ঘাটতিতেই’ পার্বত্য শান্তি চুক্তির পুরো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে অভিযোগ করে আসছেন জনসংহতি সমিতির নেতা।

রাঙামাটির পুলিশ সুপারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ জেলায় বিভিন্ন পাহাড়ি উপদলের সংঘাতে ২০১৮ সালে ১৭ জন, ২০১৭ সালে ১২ জন, ২০১৬ সালে ১২ জন, ২০১৫ সালে ১৩ জন এবং ২০১৪ সালে ২৬ জন নিহত হয়েছেন।

এ এলাকায় ২০১৮ সালে ৩টি, ২০১৭ সালে ১টি, ২০১৬ সালে ৩টি, ২০১৫ সালে ৪টি এবং ২০১৪ সালে ৩টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালে ৭টি, ২০১৭ সালে ৪টি, ২০১৬ সালে ৬টি, ২০১৫ সালে ৫টি, ২০১৪ সালে ৮টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে 

পাহাড়ি জনপদে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার যে এখনও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি, তা স্বীকার করেন দীপংকর তালুকদার। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং অন্যান্য বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে কাজ করছে। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে নিয়ে সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তোলা হচ্ছে।

“আগে কোনো ঘটনা ঘটলে মামলা হত না। কেউ ভয়ে মামলা করত না; কিন্তু এখন মামলা হচ্ছে।” 

রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবির বলেন, “এখন সশস্ত্র কোনো গোলাগুলি হয় না। এটাই এ এলাকার মানুষের জন্য শান্তি। শান্তি চুক্তির কারণে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর সশস্ত্র গোলাগুলি হয় না।”

সন্ধ্যার পর সাধারণ মানুষকে আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করতে হয়, পাহাড়ে যে চাঁদাবাজি চলে- তার ভাগ পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজনও পায়- স্থানীয়দের এসব অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পুলিশ সুপার বলেন, “ভৌগলিক কারণে সন্ধ্যার পর অনেক এলাকা নীরব থাকে। তখন এসব এলাকা অপরাধীরা অভয়ারণ্য হিসেবে বেছে নেয়। তারপরও পুলিশ কাজ করছে জেলাবাসীর নিরাপত্তায়।”

আর চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন,  “চাঁদাবাজির বিষয়টি আমাদের কাছে গল্পের আকারে আসে। জানতে চাইলে তখন কিছু বলে না, আর থানায় কেউ অভিযোগও করে না।”

রাঙামাটির সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার বলেন,  “আসল অর্থে ক্ষমতায়ন হয়নি। যার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম – তা হল ক্ষমতা। ক্ষমতার অংশীদারিত্বের বাস্তবায়ন হয় নাই। জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদকে ‘যথাযথভাবে ক্ষমতায়ন’ করা হয় নাই।”

তিনি বলেন, “কিছু যে দেওয়া হয় নাই তা নয়। আমি বলব না যে এত পার্সেন্ট; ওই পার্সেন্ট বাদ দিলেও মৌলিক বিষয়গুলো সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, বন ও পরিবেশ, ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং শরণার্থী যারা ফিরে এসেছে তাদের যথাযথভাবে পুনর্বাসন- এই নানা বিষয়গুলো এখনও ঝুলে আছে। ঝুলিয়ে রাখা ঠিক হচ্ছে না।”

পুরনো খবর