তাবলিগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ইজতেমা মাঠ রণক্ষেত্র, নিহত ১

টঙ্গীতে জোড় ইজতেমাকে কেন্দ্র করে তাবলিগ জামাতের দিল্লি মারকাজ এবং দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারী দুই পক্ষের সংঘর্ষে সত্তর বছর বয়সী এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকও গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2018, 04:11 AM
Updated : 2 Dec 2018, 02:43 AM

এই উত্তেজনার মধ্যে শনিবার সকাল থেকে বিমানবন্দর সড়কের টঙ্গীমুখী অংশে যান চলাচল বন্ধ থাকায় সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে বিদেশগামী এবং দূর পাল্লার যাত্রীরা।

গাজীপুর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক একেএম কাওসার চৌধুরী জানান, সংঘর্ষের মধ্যে ইসমাইল মণ্ডল নামে মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

সকালে সংঘর্ষ শুরুর পর দুপুর ১২টা পর্যন্ত দুই শতাধিক লোক টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসা নিতে গেছেন জানিয়ে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. পারভেজ হোসেন বলেছেন, আহতদের মধ্যে ২০ জনকে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের নেতৃত্বের কোন্দলে জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব গত মাসে স্থগিত করা হয়। দেওবন্দপন্থিদের আবেদনে নির্বাচন কমিশন শুক্রবার এক আদেশে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের আগে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে সব ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করে একটি নির্দেশনা জারি করে।

দিল্লি মারকাজের মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভির অনুসারীরা এর মধ্যেই পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা করার ঘোষণা দিলে দেওবন্দপন্থি মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা দিন কয়েক আগে ইতজেমা মাঠ দখল করে আশপাশে পাহারা বসায়। এ অবস্থায় মাওলানা সাদের অনুসারীরা শুক্রবার ময়দানে ঢুকতে না পেরে আশপাশের মসজিদে অবস্থান নেন।

 

শনিবার ভোর থেকে সাদের অনুসারী শত শত মানুষ ঢাকার দিক থেকে টঙ্গীর পথে রওনা হলে পরিস্থিতি বিস্ফোরন্মুখ হয়ে ওঠে। বিমানবন্দর সড়কসহ টঙ্গীর পথের বিভিন্ন স্থানে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হলে বিমানবন্দর সড়কের এক দিকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি মো. কামাল হোসেন জানান, জোড় ইজতেমায় যোগ দিতে আসা লোকজন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ময়দানের ফটকের তালা ভেঙে এবং সীমানা প্রচীর টপকে ভেতরে ঢুকে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ সময় দুই পক্ষের লোকজন বাঁশ ও লাঠিসোঁটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

সংঘর্ষের মধ্যে দুই পক্ষ থেকেই বৃষ্টির মত ঢিল ছোড়া হয়। সেই ঢিল আর লাঠির আঘাতে উভয়পক্ষের দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। এক পর্যায়ে সাদের অনুসারীরা অন্য পক্ষকে পিটিয়ে বের করে দিয়ে মাঠের দখল নেয়।

পরে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। গাজীপুরের মেয়র ও পুলিশ কমিশনার তাবলিগের দুই পক্ষের মুরুব্বিদের নিয়ে মাঠের ভেতর বৈঠক করে আধা ঘণ্টার মধ্যে সবাইকে মাঠ ছেড়ে দিতে বলেন। পুলিশের পক্ষ থেকেও মাইকিং করে সবাইকে ওই এলাকা ত্যাগ করতে অনুরোধ করা হয়।

গাজীপুরের জেলা প্রশসক দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে আমরা মাঠে সব ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছি। নির্বাচনে আগে ইজতেমা মাঠ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে। পরে আলোচনা করে ইজতেমার তারিখ দেওয়া হবে।”

তাবলিগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের পর টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে আহত দুইজন।

সাদপন্থি হিসেবে পরিচিত তাবলিগ জামাতের সুরা সদস্য মাওলানা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম জানান, নিহত মো. ইসমাইল মণ্ডল মুন্সীগঞ্জ সদরের খলিল মণ্ডলের ছেলে। ইসমাইল তাদেরই অনুসারী ছিলেন। 

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং মহানগর পুলিশের কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান দুপুরে ঘটনাস্থল ও টঙ্গী হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।

এদিকে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষের কারণে সকাল থেকেই মহাখালী থেকে টঙ্গীগামী সড়কের এক পাশে যান চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিমানবন্দর জোনের সহকারী কমিশনার মিজানুর রহমান জানান।

তাবলিগের দুই পক্ষ বিমানবন্দরের সামনের গোল চত্বরের দুই দিকে অবস্থান নিয়ে থাকায় বহু মানুষকে লটবহর নিয়ে পায়ে হেঁটে বিমানবন্দরে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে দেখা যায়। ঢাকা থেকে বের হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ এই পথ দীর্ঘ সময় আটকে থাকায় দূর পাল্লার বাস যাত্রীদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। 

সংঘর্ষ থামার পর পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে এলে দুপুর সোয়া ১টার দিকে ধীরে ধীরে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হতে থাকে বলে গাজীপুর ট্রাফিক দক্ষিণ জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার থোয়াই অংপ্রু মারমা জানান।

সাদপন্থি মাওলানা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই পক্ষের লোকজন কয়েক দিন ধরে মাঠ দখল করে রেখেছে। ছোট ছোট ছেলেরা সেখানে আমাদের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। জোড় ইজতেমায় যোগ দিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসল্লিরা ময়দানে যাওয়ার চেষ্টা করলে তারা বাধা দিয়েছে। এ কারণে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।”

অন্যদিকে মাওলানা জুবায়েরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত তাবলিগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য মাওলানা আবদুল কুদ্দুস বলেন, “বাচ্চারা না, ওখানে বড়রাই আছে। তারা বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতির জন্য কাজ করছে। সাদের পক্ষের লোকজন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য আজ সেখানে যেতে চাইছে।”

বিমান বন্দর গোল চত্বরের উত্তর দিকে অবস্থান নিয়ে থাকা  জুবায়েরের অনুসারীদের জটলার মধ্যে বাব উস সালাম মাদ্রাসার ছাত্র মোহাম্মদ হানিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে সাদের লোকজন আমাদের ওপর হামলা চালায়। প্রথমে তারা ইজতেমা ময়দানের দিকে আসতে থাকে। আমাদের লোকজন তাদের মাঠে না যেতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে আমাদের ওপর আক্রমণ করে। এতে আমাদের ৫-৬ জন আহত হয়।”

তাবলিগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার কারণে বিমানবন্দর সড়কের একপাশে যান চলাচল বন্ধ থাকায় দূর পাল্লার যাত্রীরা পড়েন ভোগান্তিতে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

অন্যদিকে বরিশাল থেকে আসা সাদ সমর্থক দুলাল তালুকদার বলেন, “আমরা সকালবেলা জোড় ইজতেমায় যোগ দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের আটকে দেয়। কোনোভাবেই আমাদেরকে মাঠে যেতে দিচ্ছে না। আমরা কোনো ধরনের হামলা করিনি। পুলিশকে জানানো হয়েছে। আমরা মাঠে যেতে চাই।”

সংঘর্ষ থামার পর বিকালে বিবাদমান পক্ষ দুটির সঙ্গে বৈঠক করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, বিশ্ব ইজতেমার তারিখ ঠিক করা হবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর।

উপমহাদেশে সুন্নী মতাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় সংঘ তাবলিগ জামাতের মূলকেন্দ্র ভারতের দিল্লিতে। মাওলানা সাদের দাদা ভারতের ইসলামি পণ্ডিত ইলিয়াছ কান্ধলভি ১৯২০ এর দশকে তাবলিগ জামাত নামের এই সংস্কারবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন।

স্বেচ্ছামূলক এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধের প্রচার। বিতর্ক দূরে রাখতে এ সংগঠনে রাজনীতি ও ফিকাহ নিয়ে আলোচনা হয় না।

মাওলানা ইলিয়াছের মৃত্যুর পর তার ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ এবং তারপর মাওলানা ইনামুল হাসান তাবলিগ জামাতের আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। মাওলানা ইনামুলের মৃত্যুর পর একক আমিরের বদলে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দেওয়া হয় একটি শুরা কমিটির ওপর।

সেই কমিটির সদস্য মাওলানা জুবায়েরের মৃত্যুর পর মাওলানা সাদ আমিরের দায়িত্ব নেন এবং একক নেতৃত্বের নিয়ম ফিরিয়ে আনেন।

এ অবস্থায় মাওলানা জুবায়েরের ছেলে মাওলানা জুহাইরুল হাসান নেতৃত্বের দাবি নিয়ে সামনে আসেন এবং তার সমর্থকরা নতুন করে শুরা কমিটি গঠনের দাবি জানান।

কিন্তু সাদ তা প্রত্যাখ্যান করলে বিরোধ বড় আকার ধারণ করে। বিভিন্ন সময়ে মাওলানা সাদের বক্তব্য নিয়েও আলেমদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়।

নেতৃত্ব নিয়ে দিল্লির মারকাজ এবং দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারীদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে চলতি বছর জানুয়ারিতে ঢাকায় বিশ্ব ইজতেমার সময়।

তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের সংঘর্ষের পর শনিবার টঙ্গীর স্টেশন রোডের চিত্র।

কয়েক বছর ধরে বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করে আসা সাদ কান্ধলভি এবার ঢাকায় এসে বিরোধীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। শেষ পর্যন্ত সরকারে মধ্যস্থতায় ইজতেমায় অংশ না নিয়েই তাকে ঢাকা ছাড়তে হয়।

বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদে ওই বিরোধের জের চলে বছরজুড়ে। গত এপ্রিলে দুই পক্ষের অনুসারীদের মধ্যে হাতাহাতিও হয়।

এই দ্বন্দ্বের মধ্যে সাদের অনুসারীরা ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর টঙ্গীতে জোড় ইজতেমা এবং ১১ থেকে ১৩ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে দেওবন্দপন্থিরা ৭ থেকে ১১ ডিসেম্বর জোড় ইজতেমা এবং ১৮ থেকে ২০ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠানের কথা জানায়।

দুই পক্ষ আলাদাভাবে ইজতেমা করার ঘোষণা দিলে উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। এই পরিস্থিতিতে গত ১৬ নভেম্বর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সভাপতিত্বে এক বৈঠক থেকে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব স্থগিত করা হয়।

ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, উভয় পক্ষের মধ্যে সমাঝোতার মাধ্যমে বিশ্ব ইজতেমার একটি তারিখ নির্ধারণে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভারতের দেওবন্দে যাবে। দুই পক্ষ সমঝোতায় এলে নতুন তারিখ ঘোষণা করা হবে।

কিন্তু সাদপন্থিরা ৩০ নভেম্বর থেকে জোড় ইজতেমা করার প্রসন্তুতি নিলে অন্যপক্ষ তুরাগ তীরে ইজতেমা মাঠের সব কটি ফটকে পাহারা বসায়। এই পরিস্থিতিতে সাদপন্থীরা গত ২৭ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে।

অন্যদিকে জুবায়েরপন্থিরা গত ২৪ নভেম্বর ইসিতে চিঠি দিয়ে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘ভয়াবহ অবনতির শঙ্কা’ প্রকাশ করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করে।

এর ভিত্তিতে ইসির যুগ্মসচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান শুক্রবার গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে চিঠি দিয়ে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের আগে টঙ্গীতে তাবলিগ জামাতের যে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান না করার নির্দেশনা দেন।