যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনায় বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ

যুক্তরাষ্ট্রে একটি আলোচনা সভায় বাংলাদেশে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ ও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমনের অভিযোগ তুলে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন অধিকারকর্মী।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Nov 2018, 05:01 PM
Updated : 16 Nov 2018, 05:53 PM

বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের একটি কক্ষে ওই আলোচনায় উপস্থিত না থাকলেও আয়োজক সংগঠন ‘টম ল্যান্টোস হিউম্যান রাইটস কমিশন’র কো-চেয়ার কংগ্রেসের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের দুই সদস্য বিবৃতিতে এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। তবে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করেছেন তারা।

‘বাংলাদেশে নির্বাচন ও মানবাধিকার’ শিরোনামের এই আলোচনার কক্ষে সম্প্রতি ঢাকা ছেড়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, জামায়াতে ইসলামীর আইনি পরামর্শক ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, বাংলাদেশ দূতাবাসের উপ-প্রধান মাহবুব সালেহ এবং যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাও ছিলেন সেখানে।

আলোচনায় বাংলাদেশ সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়ার অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর জন সিফটন।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। গুম-খুনের ঘটনাও ঘটছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে। বিরোধী দলের লোকজন স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারছে না। বিশেষ বাহিনীর দমন-পীড়নে ভীত-সন্ত্রস্ত অনেকে।”

র‌্যাবের বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তুলে অবিলম্বে তা বন্ধের আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, “এমনকি গণমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে এমন ভয় আর ভীতি। ফলে সাংবাদিকরা ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, বাংলাদেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে।”

আলোকচিত্রী শহীদুল ইসলামের গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন সিফটন। নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতির অবসানে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তিনি।

যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের একটি কক্ষে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার ও নির্বাচন’ শীর্ষক আলোচনা সভার দর্শকদের একাংশ। ছবি-বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

সিফটন বলেন, “অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে পরবর্তীতে যে সরকার ক্ষমতা নেবে তাদের বৈধতা থাকবে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কার্যকর রাখতেই অবাধ-সুষ্ঠু পরিবেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের বিকল্প নেই।”

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই কর্মকর্তা ইঙ্গিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম থেকে বাংলাদেশিদের নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন।

“যারা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লংঘনের সাথে জড়িত, তারা শান্তিরক্ষায় থাকা উচিত নয়,” বলেন তিনি।

ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলের ‘রেবার্ন হাউজ বিল্ডিংয়ে’ এই সভার অপর আলোচক ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমের পলিসি এনালিস্ট ওয়ারিস হুসেইন রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

তিনি বলেন, “নিকট প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোতে ঠাঁই না পেলেও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। এটি অবশ্যই প্রশংনীয় একটি ঘটনা। ছোট্ট একটি দেশ, যেখানে ১৬ কোটি মানুষ বাস করছে, সেই ঘিঞ্জি অবস্থার মধ্যেই প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে মহানুভবতা দেখিয়েছে তাকে অবজ্ঞার অবকাশ থাকতে পারে না।”

তাদের এই আলোচনা, মতামত প্রকাশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের নীতি-নির্ধারকদের কোনো যোগসূত্র না থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা স্বাধীনভাবে যা পর্যবেক্ষণ করছি তার ওপরই আলোকপাত করছি, যাতে কংগ্রেস আমাদের এ আলোচনায় কিছুটা তথ্য-উপাত্ত পায়।”

নির্বাচন এলেই বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিগৃহীত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “নির্বাচন এলেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অত্যাচার-নির্যাতন আর হুমকি-ধমকির মুখে পড়েন-এটি অনেক দিন থেকেই চলে আসছে। ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা রাজনৈতিক মতলবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের ওপর চড়াও হয়।

“২০১৪ সালের নির্বাচনের সময়েই বাংলাদেশের হিন্দু, খ্রিস্টান আর বুদ্ধরা আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের ব্যবসা, বাড়ি-ঘর লুট করা হয়েছে। সে সময়ের বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এমন বর্বরতা চালায়। তার পরিপ্রেক্ষিতেই আসন্ন নির্বাচনে যাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় সে আবেদন জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।”

ঐক্যপরিষদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, গত তিন বছরে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু আক্রান্তের হার কমছে। ২০১৬ সালে ছিল ১৫০০, ২০১৭ সালে ১০০০ এবং চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত এ ধরনের হামলার ঘটনা ৩৮০টি ঘটেছে।

“আমার মনে হচ্ছে সরকার এবং নিরাপত্তা সংস্থা সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে যে জিরো টলারেন্স অবলম্বন করেছে তারই সুফল এটি।”

আলোচনার আয়োজক সংস্থার কো-চেয়ার ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান র‌্যান্ডি হাল্টগ্রেন এবং ম্যাসেচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান জেমস পি ম্যাকগোভার্ন শুনানিতে ছিলেন না।

এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ হওয়ার আহ্বান জানান তারা।পাশাপাশি লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানান তারা।

বিবৃতিতে র‌্যাবের বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তোলেন তারা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাত দিয়ে তারা বলেন, “এ বছর মে থেকে অগাস্টের মধ্যে ২০০ লোক নিহত হয়েছে র‌্যাবের হাতে।”

মাদক নির্মূলের আড়ালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির অভিযোগও করা হয়েছে বিবৃতিতে।

এ আলোচনায় অংশ নিয়ে অপর প্যানেলিস্ট ওয়ার্ল্ড ভিশন ইউএসএ’র চাইল্ড প্রটেকশন অ্যান্ড এডুকেশন বিষয়ক সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার লোরা ব্র্যামোন বলেন, “বাংলাদেশে শিশুদের নিরাপত্তায় আইন থাকলেও তার কার্যকারিতা খুব একটা নেই। বিশেষ করে বাল্য বিয়ের ঘটনা এখনও বাংলাদেশে উদ্বেগজনকভাবে ঘটেই চলছে।

“সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক শিশু নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। মাদক-ব্যবসার বাহনেও পরিণত করা হচ্ছে অসহায় শিশুদের। এমনকি দরিদ্র বাবা-মার সন্তানরা পাচারকারীর খপ্পড়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে সরকারসহ সকল মহলের আন্তরিকতা প্রয়োজন।”

লোরা বলেন, বাংলাদেশে আমরা কাজ করছি শিশু, পরিবার, সরকার এবং ধর্মীয় আলোচনার সঞ্চালনায় ছিলেন থিঙ্ক ট্যাংক ‘ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি’র এশিয়ার সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মোনা দেভি। সূচনা বক্তব্যে বাংলাদেশের নির্বাচন এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।

আলোচনার সময় ফ্লোরে থাকা যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের গোলাম দস্তগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটি ছিল জামাত-শিবিরের মদদের একটি আলোচনা। সেজন্যেই নিউ ইয়র্কের শিবিরের এক ক্যাডারের সাথে এসেছিলেন ব্রিটিশ ব্যারিস্টার টবি ক্যাডম্যান। টবি অবশ্য প্রশ্নোত্তর পর্বেও অংশ নেননি।”