শুক্রবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘মি টু মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ আয়োজিত এই মানবন্ধনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক বলেন, শুধু নারীরা নয়, ছোট ছোট ছেলেরাও নিকটাত্মীয়দের মাধ্যমে নির্যাতত হয়। অনেক সময় ঘরেও তারা নিরাপদ নয়। এর বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
“আপনি পুরুষ, কিন্তু আপনার মা একজন নারী, আপনার মেয়ে সন্তান থাকতে পারে। আপনার মেয়ে সন্তান না থাকলেও আপনার ভাইয়ের মেয়ে আছে, আপনার বোন আছে। নারীদের জন্য ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তলুন। নারীর কর্মক্ষেত্র যেন সংকুচিত না হয়, নারীরা আরও সাহসী হয়ে তারা তাদের কাজের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে।”
ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, প্রশাসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠার প্রসঙ্গ তুলে ধরে নাসিমুন আরা বলেন, “কেউ আছেন অনেক ধনী, বড় সাহিত্যিক, অনেক মেধা, সমাজে তার অনেক অবদান। কিন্তু তার যতই অবদান থাক, যতই গুণী হোক, তিনি তো নারীর উপর নির্যাতন করতে পারেন না।
“এই ধরনের অনাচার, অপরাধীর বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। আমরা যদি লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকি, তাহলে আপরাধীরা অন্যায় করে যাওয়ার সুযোগ পাবে। সেজন্য আমাদের মুখ খুলতে হবে। যারা মুখ খুলেছে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।”
আগামী ১৮ নভেম্বর রোববার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করার ঘোষণা দিয়ে নাসিমুন আরা বলেন, “আগামীতেও এ আন্দোলন চলবে।”
তিনি বলেন, অভিযোগ আসার পর কয়েকটি সংগঠন দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে, এই ধরনের সচেতনতা যেন সব প্রতিষ্ঠানেই থাকে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েদের হয়রানির শিকার হওয়ার চিত্র তুলে ধরে নাসিমুন আরা বলেন, “যেখানেই ঘটনা ঘটবে, সেখানেই যেন আমরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি, অ্যাকশন নিতে পারি।”
সব সংবাদমাধ্যম, সব করপোরেট প্রতিষ্ঠান, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর হয়রানি বন্ধে হাই কোর্টের রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে তিনি বলে, “সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কমিটি করতে হবে। সরকারের কাছে আমাদের আহ্বান, হাই কোর্টের রায়কে আইনে পরিণত করুন।”
নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি বলেন, হাজার বছর ধরে যে পশ্চাদপদ মন, সেই অন্ধকার একদিনে দূর হবে না।
“কিন্তু সবাই মিলে চেষ্টা করলে সেই অন্ধকার দূর হবে। সেই কাজটা আমাদের শুরু করতে হবে। নারীকে শ্রদ্ধা করতে হবে, কারণ নারীরাও এদেশের নাগরিক।”
#মি টু ২০০৬ সালে আফ্রো আমেরিকান সামাজিক আন্দোলনের কর্মী তারানা বুরকি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নারীর উপর যৌন নিপীড়নের বিষয়ে প্রথমবারের মতো ‘মি টু’ ধারণার কথা বলেন, পরে একই নামে একটি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় পরে হলিউড অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #মি টু আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এরপর একে একে মুখ খুলতে থাকেন হলিউডের অভিনেত্রীরা। নীরবতা ভেঙে যৌন নিগ্রহের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান দিতে থাকেন নারীরা। এরপর এর ধাক্কা এসে লাগে ভারতে। শুধু রুপালি জগতেই নয়, রাজনীতিসহ অন্যান্য মাধ্যমেও যৌন নিপীড়নের কথা মুখ ফুটে বলতে শুরু করেন তারা। সম্প্রতি বাংলাদেশের নারীরাও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মি টু হ্যাশ ট্যাগে তাদের নিপীড়নের কথা বলতে শুরু করেছেন। এর ধারাবাকিতায় ‘মি টু মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ শিরোনামে এই সংহতি সমাবেশ। |
বাংলাদেশ উইমেন জার্নালিস্টস ফোরামের সভাপতি মমতাজ বিলকিস মানববন্ধনে বলেন, ছোটরা কেঁদেকেঁদে বলে দিলেও যারা একটু বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে তারা যখন আকার-ইংগিতে বলতে চেয়েছে তখন মায়েরা বাধা দিয়েছে। আর এভাবে নিপীড়নের মাত্রা বেড়েছে।
“অসভ্য লোকগুলো এমন পর্যায়ে গেছে, মেয়েরা ঘরে-বাইরে, কর্মস্থলে, হাটে-বাজারে নিরাপদে চলতে পারে না। প্রতিবাদ নেই বলে এদের এত সাহস বেড়ে গেছে যে ধর্ষণের সেঞ্চুরিও তারা প্রকাশ্যে করতে পারে। এজন্য সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।”
বিলকিস বলেন, ‘#মি টু’ কী- সে বিষয়ে অনেকের এখনও স্পষ্ট ধারণা নেই। এ বিষয়ে সবাইকে বোঝাতে হবে।
“সব সম্পাদকের কাছে অনুরোধ করব, তারা যেন একটা কলাম এই মিটুর জন্য রাখেন যেন মেয়েরা তাদের মনের কথাগুলো ইচ্ছেমত বলতে পারে, সমাজকে সচেতন করার পদক্ষেপ তারা নিতে পারে। লজ্জা ঢেকে রাখার প্রথা পরিবর্তন করতে হবে। এজন্য সংবাদপত্রকে বিষয়টি অনেক গুরুত্ব দিতে হবে।”
উইমেন জার্নালিস্টস ফোরামের সভাপতি বলেন, ‘#মি টু’ পুরুষবিরোধী কোনো আন্দোলন নয়। এটা সমাজকে ‘কীটমুক্ত’ করার আন্দোলন।
বাংলাভিশনের বার্তা সম্পাদক শারমিন রিনভী বলেন, “লজ্জার বলে সব কিছু চাপিয়ে রাখলে নিপীড়ন বাড়বে এবং বাড়ছে। তারা বলেছে বলে আমাদের না বলা কথাগুলো বলা হচ্ছে।… এটা মেয়েদের নয়, মানুষের আন্দোলন। যারা নিপীড়ন করছে, তাদের পরিচয় উন্মোচন হোক।”
একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার কথা তুলে ধরে রিনভী বলেন, “তিনি নির্বাচনে দাঁড়াবেন বলে শোনা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনুরোধ, তাদের প্রার্থী করবেন না। নিপীড়ক যেখানেই থাকবে তাদের বয়কট করতে হবে।”
যারা সাহস করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যৌন নিপীড়ন নিয়ে কথা বলছেন, তাদের অভিনন্দন জানান নিউজ টোয়েন্টিফোরের যুগ্ম-বার্তা সম্পাদক আঙ্গুর নাহার মন্টি।
তিনি বলেন, “শুধু মেয়ে না, ছেলেদের উপরও যৌন নির্যাতন হয়। তাই আমার প্রত্যাশা, দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষ এই আন্দোলনে থাকবেন।
সাপ্তাহিক অপরাধ বিচিত্রার সাংবাদিক নাদিরা দিলরুবা সংহতি মানববন্ধনে অংশ নিয়ে জানান, ১০ বছর বয়সে মায়ের চাচাত ভাই জালাল উদ্দিনের হাতে যৌন নির্যাতনের ঘটনা তিনি মিটু হ্যাশ ট্যাগে লিখেছেন।
বিবেকের তাড়নায় মি টুতে লিখেছেন জানিয়ে নাদিরা বলেন, “আমরা পরিবার থেকেই প্রথম যৌন নিপীড়নের শিকার হই।”
ফেইসবুকে মি টু হ্যাশট্যাগে নিজের যৌন হয়রানির ঘটনা জানানো মুশফিকা লাইজু বলেন, “একজন নারী তার সারা জীবনের যৌন হয়রানির কথা সাদা কাগজে লিখলে সেই কাগজে পৃথিবী ঢেকে রাখা যাবে।”
নারী সাংবাদিক সমিতির সভাপতি নাসিমা সোমা বলেন, “আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে সফল হব। এখন ১১ বছরের পুরানো ঘটনাও নতুন করে প্রকাশ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে, তাই অনেক বিষয় প্রকাশিত হচ্ছে।”
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শুক্কুর আলী শুভ তার সংগঠনের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনে সংহতি জানান।
বাংলাদেশ সংসাদ সংস্থার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক কবির আহমেদ খান এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন।
সমাপনী বক্তব্যে বাংলা ট্রিবিউনের প্রধান প্রতিবেদক উদিসা ইসলাম বলেন, “যারা ‘মি টু’ বলেছেন, তাদের প্রতি আমরা যেমন সংহতি জানাচ্ছি, যারা ‘মি টু’তে অভিযুক্ত হচ্ছেন, অভিযোগ নিয়ে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাস্যরস করছেন, তাদের প্রতি আমরা কিছু বার্তা দিতে চাই।
“আপনাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিকতা থেকে যদি এই আন্দোলনকে গ্রহণ নাও করতে পারেন, এই আন্দোলন নিয়ে কোনো হাস্যরস করার চেষ্টা করবেন না। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে যারা আজ এখানে দাঁড়িয়েছে, তারা আপনাদের সেই চেষ্টা প্রতিহত করবে।”
উদিসা বলেন, “মি টু আন্দোলনে অভিযুক্তের বিষয়ে ডেইলি স্টার প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। আমরা চাই আরও যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিষ্ঠান যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এটি নিয়ে যেন আমাদের বলতে না হয়, এটি তাদের নিজেদের দায়িত্ব “
এ আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে চলবে এবং মি টুতে যারা কথা বলেছেন, আগামীতেও তারা রাজপথে সরব হবেন বলে জানান উদিসা।
অন্যদের মধ্যে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক এফ এম শাহীন, বাংলাদেশ অনলাইন জার্নালিস্ট ফোরামের সহ-সভাপতি রোজি ফেরদৌস সমাবেশে বক্তব্য দেন।