‘আলসেখানার বাসিন্দা’ থেকে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা

‘অলস প্রকৃতির’ শেখ হাসিনা কীভাবে বাবা-মাসহ স্বজন হারানোর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করেছেন; সেই গল্পের সঙ্গে নৌকায় চড়ে তার প্রথম ঢাকায় আসার অভিজ্ঞতা, রান্না শেখাসহ নানা অজানা ঘটনা ধরা দিয়েছে সেলুলয়েডে।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Nov 2018, 04:41 PM
Updated : 15 Nov 2018, 07:02 PM

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে তল্লাশির সময় পুতুল পোড়ানোয় তার ১১ বছর বয়সী মনের কষ্টের কথাও উঠে এসেছে ‘হাসিনা: আ ডটার’স টেল’ প্রামাণ্যচিত্রে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানার জবানিতে নির্মিত হয়েছে এই প্রামাণ্যচিত্র।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পিপলু খান নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রটির প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয় বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে।

প্রামাণ্যচিত্রে শেখ হাসিনা বলেন, ছোট বেলায় তিনি কিছুটা ‘অগোছালো প্রকৃতির’ ছিলেন। নিজের কক্ষে নিবিষ্ট থেকে গান শুনতে আর বই পড়তেই ভালো লাগত তার।

এর বিপরীতে ছোট বোন শেখ রেহানা মা ফজিলাতুন নেসা মুজিবের মতো সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুবর্তী ছিলেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ সময় শেখ রেহানা বলেন, “আপার ‍রুমের নাম ছিল আলসেখানা। নিজের রুমে নিজের মতো থাকতেন।”

প্রামাণ্যচিত্রটির প্রিমিয়ার প্রদর্শনীর দিন ঢাকায় আরেক অনুষ্ঠানে বাবার প্রতিকৃতির সামনে দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ছবি: সাইফুল ইসলাম কল্লোল

প্রামাণ্যচিত্রের শেষে এই সাধারণ শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠার প্রসঙ্গও উঠে আসে শেখ রেহানার জবানিতে।

তিনি বলেন, বাবার সঙ্গে মাকেও হারানোয় তারা একেবারে একা হয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের হারিয়ে কষ্টের জীবন পার করতে তাদেরকে।

“আমার খুব করে মন চায়, আজ মাকে যদি বলতে পারতাম তোমার হাসু আর আলসেখানায় থাকে না। বনানী কবরস্থানে গিয়ে ভাবি, যদি তাকে এখনও চিঠি লিখতে পারতাম!”

‘হাসিনা: আ ডটার’স টেল’ প্রামাণ্যচিত্রে বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব

১৯৫২ সালে প্রথম ঢাকায় আসার অভিজ্ঞতার কথাও প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু পরিবারই তিন মাল্লার ওই বড় নৌকার মালিক ছিলেন।

আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যস্ত ও কারাবন্দি থাকায় বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়ায় যেতে না পারায় পরিবারের অন্যদেরকে সে সময় ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল।

শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা প্রথম ১৯৫২ সালে ঢাকায় আসলাম। নৌকায় করে আসছিলাম ঢাকায়। তিন মাল্লার নৌকা। নৌকার ভেতরে রান্না হত, নৌকার ভেতরে থাকা যেত। বড় থাকায় আমরা দৌড়াদৌড়িও করতে পারতাম।”

নৌকায় চড়ে ঢাকায় আসতে সে সময় চার দিন সময় লেগেছিল তাদের।

কোন প্রণোদনায় নির্মাণ করেছেন ‘হাসিনা: আ ডটার’স টেল’, তা নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি পিপলু খান

টুঙ্গিপাড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে ঘুরে-ফিরে আনন্দে বেড়ে ওঠার কথাও প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। বাড়ির পাশের খালে ঝাঁপাঝাপির কথাও তুলে ধরেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “আমার কাছে টুঙ্গিপাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে ‍সুন্দর স্থান। গ্রামে ঘুরতাম, ফিরতাম। খালে ঝাঁপ দিয়ে বেড়াতাম।”

রাজনীতি থেকে অবসরে গেলে আবার টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে ফেরার ইচ্ছার কথাও প্রামাণ্যচিত্রে বলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

প্রামাণ্যচিত্রে আইয়ুব আমলে ছোটবেলার পুতুল পোড়ানোর মনোকষ্ট শেখ হাসিনার জবানিতেই উঠে আসে।

তিনি বলেন, “১৯৫৮ সালে আইয়ুব সামরিক শাসন জারি করলে আমাদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে আমাদের সব জিনিসপত্র তছনছ করে ফেলা হয়। আমার পুতুল খেলার জিনিস পুড়িয়ে ফেলে ওরা। মনে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম।”

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআরআইর ব্যানারে নির্মিত হয়েছে এই চলচ্চিত্র, যাতে যুক্ত রয়েছেন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকও

প্রামাণ্যচিত্রে শেখ রেহানার জবানিতে শেখ হাসিনার উপর ২০০৪ সালে ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা তুলে ধরা হয়।

শেখ রেহানা জানান, সেদিন তার বাসায় অতিথি এসেছিল। তাদের জন্য আতিথেয়তার আয়োজনের মধ্যে টেলিভিশনে ওই খবর দেখেন তিনি।

“প্রথমে শুনি আপা নাই। একবার এক রকম খবর শুনি। পরে দেখি আপা গাড়িতে। তার পুরো শরীরেও রক্ত।”

১৯৭৫ সালের ১৪ অগাস্ট রাতে ইউরোপে ‘ক্যান্ডেল লাইট’ ডিনারে উল্লাসে মেতে থাকলেও পরদিন বাবা-মাসহ পরিবারের সবাইকে হারানোর খবরে পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার কথা তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুর বেঁচে যাওয়া দুই কন্যা।

রেহানা বলেন, “আমাদের প্রথম ক্যান্ডেল লাইট ডিনার, আমরা খুব আমোদ-ফুর্তি করছিলাম। দুলাভাইয়ের ঘুমের ডিস্টার্ব হচ্ছিল। তিনি ঠাট্টা করে বলছিলেন, ‘এত আনন্দ কইরো না, এর ফল ভালো হয় না’। তার কথাটাই মনে হয় ঠিক হয়ে গেছে।”

টেলিফোনে পরিবারের সবাইকে হত্যার খবর পেয়ে মুষড়ে পড়ার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “ওই টেলিফোন আওয়াজের মতো কর্কশ সাউন্ড বোধহয় আর নাই। সেই আওয়াজ এখনও যেন মনে বাজে।”

চেনা বলয়ের বাইরে শেখ হাসিনার অচেনা রূপ দেখতে স্টার সিনেপ্লেক্সে জড়ো হয়েছিলেন রাজনীতিক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বসহ অনেকে

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর যুবলীগের নূর হোসেন শহীদ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তার সঙ্গে আলাপের প্রসঙ্গও প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

“নূর হোসেন ছেলেটা আমার গাড়ির কাছে এসেছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, এই ছেলে তুমি যেটা লিখছো, এটা দেখলে তোমাকে মেরে ফেলবে। সে বলল, আপনি আমার মাথায় হাত রাখেন, আমি প্রয়োজন হলে জীবন দিয়ে দিব।”

এর পরপরই বোমা হামলা ও গুলিবর্ষণ শুরু হওয়ার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার গাড়িটা গোলাপ শাহ মাজারের দিকে গেলে পুলিশ আটকে দেয়। গাড়ি থেকে দেখি নূর হোসেনকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছেলেটির কথাই যেন ঠিক হল।”

গণভবনে শেখ হাসিনার রান্নার ভিডিও দিয়ে শুরু হওয়া এই প্রামাণ্যচিত্রে নিজের রান্না শেখার কাহিনীও শোনান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “বিয়ের পরও আমি তেমন রান্না বান্না করতাম না। মা অনেক ভালো রান্না করতে পারতেন। আমার বাসায় মেহমান আসলে মাকে জানাতাম, তিনি সব খাবার রান্না করে পাঠিয়ে দিতেন।”

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দিল্লিতে নির্বাসনের সময় ‘উপায় না থাকায়’ রান্না শিখেছিলেন বলে জানান শেখ হাসিনা।

কেমন দেখলেন ‘হাসিনা: আ ডটার’স টেল’, তা নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি আবুল মাল আবদুল মুহিত

প্রামাণ্যচিত্রটির দেখে আসার পর অনেক কিছু নতুন জানার কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও।

তিনি বলেন, “এ এক চমৎকার ছবি; অভূতপূর্ব ও কালোত্তীর্ণ ছবি! এটা শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে, একটি মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে। অত্যন্ত সার্থক ছবি। অনেক কিছু নতুন জানলাম।”