রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন স্থগিত করার আহ্বান জাতিসংঘের

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া স্থগিতের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল বাশেলেট বলেছেন, রাখাইনে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হওয়ার আগে ফেরত পাঠানো হলে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসা ওই জনগোষ্ঠীর জীবন ফের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। 

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Nov 2018, 04:28 AM
Updated : 14 Nov 2018, 04:36 AM

প্রত্যাবাসন শুরুর সব প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়ার মধ্যেই মঙ্গলবার জেনিভা থেকে এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান বলে রয়টার্সের খবর।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তির ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার থেকে এই প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা। দুই দেশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম ধাপে ২২৬০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। প্রতিদিন ১৫০ জন করে ১৫ দিনে প্রথম ধাপের এই প্রত্যাবাসন শেষ হবে।

কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরার মত অনুকূল পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয়নি মন্তব্য করে এর আগে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি এবং মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লিও প্রত্যাবাসন স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

মিশেল বাশেলেট তার বিবৃতিতে বলেন, শরণার্থীদের বলপূর্বক ফেরত পাঠানো হলে তা হবে ‘আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন’।

গতবছর অগাস্টে রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তাদের কক্সবাজারের কয়েকটি কেন্দ্রে আশ্রয় দিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় জরুরি মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার।

আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গতবছরের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও নানা কারণে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত গত ৩০ অক্টোবর ঢাকায় দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মধ্য নভেম্বর সময় ঠিক হয়।

কিন্তু জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার কর্মকর্তা ভোলকার টুর্ক মঙ্গলবার বলেন, রাখাইনে এখনও রোহিঙ্গাদের ফেরার মত অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এখনও তাদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত মিয়ানমার সরকার নেয়নি। সেখানে তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার এখনও নিশ্চিত করা হয়নি।  

আর বাশেলেটের তার বিবৃতিতে কক্সবাজারের ক্যাম্পে থাকা দুই রোহিঙ্গার আত্মহত্যা চেষ্টার কথা জানিয়ে বলেন,  “আমরা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মুখে দেখছি আতঙ্ক আর ভয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তারা।”

জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদন থেকে উদ্ধৃত করে মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার বলেন, “মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত নমুনা। সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো হয়েছে, হয়ত গণহত্যাও।”

বাশেলেট বলেন, “যেখানে জবাবদিহিতার লেশমাত্র নেই, যেখানে সহিংসতা এখনও থামেনি, সেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের  রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর অর্থ হবে তাদের আবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের চক্রের মধ্যে ছুড়ে ফেলা। এই জনগোষ্ঠী দশকের পর দশক ধরে ওই দুর্ভোগের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে।”

বিবৃতিতে বলা হয়, উত্তর রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের খবর এখনও আসছে মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনে। এর মধ্যে রয়েছে হত্যা, গুম আর গণগ্রেপ্তারের খবর।

বাশেলেট জানান, এক লাখ ৩০ হাজারের মত রোহিঙ্গা এখন রাখাইনে সরকারি আশ্রয় শিবিরে আছে। বাংলাদেশ সীমান্তের শূন্য রেখায় আছে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা। এই জনগোষ্ঠী এখনরও চলাফেরা ও অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত।

নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করে তবেই রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার।

এদিকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আবারও আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।

মঙ্গলবার নয়া দিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশনে অন্য দেশগুলোর কূটনীতিকদের এক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরেন।

তিনি বলেন,মিয়ানমারের তৈরি এ সংকটের চাপ এখন বাংলাদেশকে বহন করতে হচ্ছে। মিয়ানমারের ওপর অব্যাহত আন্তর্জাতিক চাপ এ সংকটের সমাধানে অনুঘটক হতে পারে।

পাশাপাশি বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ওআইসির যে প্রস্তাব তোলা হবে, তাতে সমর্থন দিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আহ্বান জানান তিনি। 

জাতিসংঘের ৯৯টি সদস্য দেশ ইতোমধ্যে ওই খসড়া প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছে। গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রস্তাবের পক্ষে ১৩৫টি এবং বিপক্ষে ১০টি ভোট পড়েছিল। এ ছাড়া ২৬টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল।