মি টু: পাঠক সমাবেশের বিজুর বিরুদ্ধে অভিযোগ ট্রান্সজেন্ডার শিল্পীর

পাঠক সমাবেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল ইসলাম বিজুর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন ট্রান্সজেন্ডার শিল্পী তাসনুভা আনান শিশির।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Nov 2018, 07:26 PM
Updated : 11 Nov 2018, 04:34 AM

শনিবার এক ফেইসবুক পোস্টে এই অভিযোগ করেন তিনি। তার আগে মডেল মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি ও শুচিস্মিতা সীমন্তি একইভাবে ‘যৌন হয়রানির শিকার’ হওয়ার কথা তুলে ধরেন।

তবে শিশিরের অভিযোগ অস্বীকার করে বিজু বলেছেন, ‘চাকুরি হারানো’ বা অন্য কারো ব্যবসায়িক ঈর্ষার কারণে তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করা হতে পারে।

দুপুরে তাসনুভা আনান শিশির ফেইসবুক পোস্টে বলেন, পাঠক সমাবেশে একজন উদ্যমী নারী কর্মী নেওয়া হবে শুনে তিনি চাকুরির জন্য যোগাযোগ করতে কেন্দ্রের কর্ণধার শহিদুল ইসলাম বিজুর অফিসে যান।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যখন দেখা মেলে তখন বিজু তাকে নিজের রুমে নিয়ে পরিচয়-কথা শুরু করে খাবার আনান এবং প্রয়োজনীয় কথা শেষ করে গুলশান ব্রাঞ্চের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন।

শিশির বলেন, তাকে ‘ব্রাঞ্চ সমন্বয়ের জন্য’ নিয়োগের কথা বলা হলেও সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্তদের বলা হল, তিনি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গবেষণা করবেন। বেতনের কথা জিজ্ঞেস করার পর ডাক পান অফিসে।

বিজুর অফিসে গেলে পাশে বসিয়ে তার প্রশংসা শুরু করা হয়।দরজা অটোলকে বন্ধ থাকায় বেরিয়ে যাওয়ার উপায় না থাকার কথাও লিখেছেন তিনি।

তিনি বলেন, “তখন কী করব বুঝতে পারছিলাম না।হাত-পা শীতল হয়ে আসছিল। মাথা ঠাণ্ডা রেখে ওনার সাথে স্বাভাবিক কথা বলার চেষ্টা করছিলাম। বেতনের কথা জিজ্ঞেস করলাম, উনি বললেন ১০০০০ টাকা আর বাকি ৫০০০ টাকা পারসোনালভাবে দিবেন। কথাটা শুনে মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল।

”বিজু ভাই এবার আমার পারসোনাল প্রশ্ন করলেন, কেমন ছেলে পছন্দ?? বললাম আপনার মতো মধ্যবয়স্ক নিশ্চয় ই নয়। সে আমার হাত ধরে ফেলেন।”

এরপর তার সঙ্গে যৌনতা নিয়ে কথা বলতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে জড়িয়ে ধরে ঠোটে চুমু খান বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এরপরেও তার সঙ্গে যৌনতার চেষ্টা করলে তিনি হুমকি দেন জানিয়ে শিশির লিখেছেন, “বললাম দরজা না খুললে আমি চেঁচাব। আপনি যদি আমায় রেপ করেন তাহলে এমনভাবে করেন যেন আমি মরে যাই, আর যদি সেটা না হয় তাহলে আমায় সসম্মানে যেতে দেন।

“ইচ্ছা করছিলো লোকটাকে কুত্তার মতো পেটাই। কিন্তু যার পরিচয়ে সেখানে গেলাম শুধু মাত্র তার সম্মানের কথা ভেবে চুপ করে হজম করলাম। উনি দেখলাম একটু ভয় পেলেন। তারপর দরজা খুলে দিলেন, বের হয়ে আসলাম।”

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শহিদুল ইসলাম বিজু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বই প্রকাশনাসহ নানাভাবে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করছি। আমাদের এখানে ৩০ বছর ধরে প্রচুর নারী কর্মী আছে। আমাদের অধিকাংশই মেয়ে কর্মীরা কাজ করে। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি যে, কোত্থেকে কীভাবে বললো। এটার কোনো ভিত্তি নাই। আমি কিছু বলতেও চাই না। আমার যা করণীয় সেটা আমি করব। এটা খুবই ষড়যন্ত্রমূলক একটা পদক্ষেপ।”

এই ষড়যন্ত্র কে করতে পারে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি জানি না, আমরা মনে করি, সবাই আমাদের বন্ধু। বাংলাদেশের মানুষকে পাঠক করতে আমরা সারা জীবন চেষ্টা করেছি।এখনও করে যাচ্ছি। ব্যবসায়িক জেলাসি কাদের আছে, কাদের নাই সেটা আসলে আমি একদমই জানি না। এটা টোটালি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট একটা জিনিস। আমি কখনোই এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত না।”

ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগকারীকে চেনেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ও হচ্ছে এখানে চাকরির জন্য এসেছিল। আমি ইন্টারভিউ নিয়ে আমি আমার পাবলিকেশন বিভাগে পাঠিয়েছিলাম। সেখানে সে ৩-৪ দিন কাজ করেছে। সে কম্পোজ করতে জানে না, কিছু করতে জানে না- যে কাজের জন্য তাকে নেব, সেটা আর নেওয়া হয়নি। এখানে ৫-৭ দিন কাজ করেছে।

“৫-৭ দিনের মধ্যে আমার কোনো কাজে লাগবে না বলে আমি যখন বলেছি, পরে যোগাযোগ করো। তখন সে একটা কিছু বলতে চাচ্ছিল যে, এ রকম করে কেন বাদ দেওয়া হচ্ছে? আমি জানি না, ওইটা থেকে রাগ হয়েছে কি না, বাদ দেওয়ার পর তাকে কেউ ফুসলাইছে কি-না।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমার অনেক অর্জন আছে সমাজে, আমিতো এ রকম না যে, একজন একটা অভিযোগ দিলেই সত্য হয়ে যাবে।”

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমার ভয় পাওয়ার কোনো কিছু নাই। এটা হচ্ছে একটা ষড়যন্ত্রমূলক বিষয়। আমি যেহেতু এক্সপেরিয়েন্সড না আগে। এ ধরনের কোনো কিছুর মধ্যে আমি মনে করিনি কখনো পড়ব। একটু মনে হচ্ছে, এগুলো কিভাবে কী হচ্ছে। আমার এ রকম কোনো ঘটনা নাই।”

কোন পদক্ষেপ নেবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা নিশ্চয়ই সামাজিকভাবে হচ্ছে, আমি নিশ্চয়ই কথাবার্তা বলতে শুরু করব। ফ্যাক্টগুলোতো জানানো উচিত।”

এরপর তিনি পাঠক সমাবেশের নানা অর্জনের বিষয়ে বলতে শুরু করলে তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, মি টু আন্দোলনে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত।

এক পর্যায়ে অবশ্য তিনি বলেন, “চুপ করে থাকাই ভালো। ভবিষ্যতে সত্য বেরুবে, মানুষই আমার পক্ষ নেবে।”

২০০৬ সালে আফ্রো আমেরিকান সামাজিক আন্দোলনের কর্মী তারানা বুরকি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নারীর উপর যৌন নিপীড়নের বিষয়ে প্রথমবারের মতো ‘মি টু’ ধারণার কথা বলেন, পরে একই নামে একটি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় পরে হলিউড অভিনেত্রী  অ্যালিসা মিলানো প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #মি টু আন্দোলনের সূত্রপাত করেন।

এরপর একে একে মুখ খুলতে থাকেন হলিউডের অভিনেত্রীরা। নীরবতা ভেঙে যৌন নিগ্রহের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান দিতে থাকেন নারীরা।

পরে এর ধাক্কা এসে লাগে ভারতেও। শুধু রুপালি জগতেই নয়, রাজনীতিসহ অন্যান্য মাধ্যমেও যৌন নিপীড়নের কথা মুখ ফুটে বলতে শুরু করেছেন তারা।

২০১৪ সালের মিজ আয়ারল্যান্ড মডেল মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি সম্প্রতি একই হ্যাশট্যাগ দিয়ে রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন।

এ বিষয়ে রফিকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সামনে নির্বাচন। আমি নির্বাচন করব, এ কারণে প্রতিপক্ষ গ্রুপের কাছ থেকে টাকা খেয়ে এই ধরনের মিথ্যা অপপ্রচার করছে।”

এরপর শুচিস্মিতা সিমন্তি মায়ের এক সময়কার বন্ধু-সহকর্মীর সাংবাদিক প্রনব সাহার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেন। প্রনব সাহাও ফেইসবুকে এক স্ট্যাটাসে সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন।