যুদ্ধাপরাধী লিয়াকত ও আমিনুলের ফাঁসির রায়

একাত্তরে হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, গণহত্যার মত মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার দায়ে পলাতক দুই আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় এসেছে আদালতে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Nov 2018, 06:39 AM
Updated : 5 Nov 2018, 12:21 PM

বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সোমবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে।

দণ্ডিত দুই আসমির মধ্যে হবিগঞ্জের লাখাই থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. লিয়াকত আলী একাত্তরে ছিলেন স্থানীয় রাজাকার কামান্ডার। আর কিশোরগঞ্জের আমিনুল ইসলাম ছিলেন ওই এলাকার অল-বদর বাহিনীর নেতা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় তারা বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান বলে উঠে এসেছে এ মামলার রায়ে।

রায়ে আদালত বলেছে, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে। একাত্তরে এ আসামিরা যেসব অপরাধ করেছে, তা এতটাই নৃসংশ ছিল যে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প আছে বলে ট্রাইব্যুনাল মনে করছে না।

মৃত্যু পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দুই যুদ্ধাপরাধীর সাজা কার্যকর করতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।  

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা অপরাধ করেছে তারা যদি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার পক্ষে কোনো রাজনতৈকি দলেও থাকেন, তারপরও তারা একাত্তরের দায় থেকে মুক্তি পেতে পারেন না।

এই রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবেন আসামিরা। তবে সেজন্য তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ৩৫টি মামলার ৮৫ আসামির মধ্যে পাঁচজন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। মোট ৮০ জনের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫৩ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে।

৩১২ পৃষ্ঠার রায়

সোমবার সকালে ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারক এজলাসে বসার পর বেলা ১০টা ৫০ মিনিটে রায় ঘোষণার কার্যক্রম শুরু হয়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম শুরুতেই জানিয়ে দেন, এটি ট্রাইব্যুনালের ৩৫তম রায়।

পরে ৩১২ পৃষ্ঠার রায়ের সার সংক্ষেপের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার। বিচারপতি আমির হোসেন পড়েন রায়ের দ্বিতীয় অংশ। সবশেষে বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম সাজা ঘোষণা করেন।

মামলার অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, লিয়াকত একাত্তরে ছিলেন মুসলিম লীগের কর্মী। আর আমিনুল ইসলাম ওরফে রজব আলী ওই সময়ে ছাত্র সংঘের সদস্য ছিলেন।

লিয়াকত আলী ২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। সভাপতি থাকা অবস্থাতেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। সেখানে বলা হয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাশাপাশি তিন থানা হবিগঞ্জ জেলার লাখাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ ঘটান দুই আসামি।

২০১৬ সালের ১৮ মে সন্দেহভাজন দুই যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হওয়ায় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। শেষ পর্যন্ত তাদের পলাতক দেখিয়েই বিচার চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেয় আদালত।

অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর লিয়াকত আলী ও আমিনুল ইসলামের বিচার শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আইনজীবীদের প্রারম্ভিক বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে ওই বছর ৪ ডিসেম্বর শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।

প্রতিক্রিয়া

রায় ঘোষণার সময় চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ প্রসিকিউশন টিমের সদস্যরা, তদন্ত সংস্থার প্রধান, এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সাক্ষী, আসামিপক্ষের রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।

এ মামলার প্রসিকিউটর রানাদাস গুপ্ত রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেন, “আসামিদের বিরুদ্ধে যে সাতটি অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল, প্রসিকিউশন তার সবকটি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ট্রাইব্যুনাল এ দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।”

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনকে একটি ‘কালো আইন’ আখ্যায়িত করে আসামিপক্ষের রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম বলেন, “আমি মনে করি প্রসিকিউশন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। কারণ হল, আসামি লিয়াকত আলী ১৯৭২ থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ১৩ বছর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন।

“মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যদি অপরাধ করতেন তাহলে স্বাধীনতার পরপরই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হত। কিন্তু এত বছরেও তা হয়নি। আসামি আমিনুল ইসলামের বেলায়ও একই ঘটনা। স্বাধীনতার এত বছরে তার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো মামলা হয়নি।”

তামিম বলেন, “যেহেতু আসামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি, তাই প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য প্রমাণের উপরই নির্ভর করতে হয়েছে। প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য প্রমাণে আসামিদের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে বলে আমি মনে করি না। তারপরও ট্রাইব্যুনাল আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছে এই কালো আইনের অধীনে।”

কেন ‘কালো আইন’ বলছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ আইনটি এমন একটি কালো আইন, যেখানে আসামিদের কোনো সুযোগ বা অধিকার দেওয়া হয়নি। এই অর্থে এটি কালো আইন।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা শহীদ রঙ্গু মিয়ার ছেলে মো. জুম্মান মিয়া এ মামলার তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। রায়ের পর তাকে কাঁদতে দেখা যায়।

পরে জুম্মান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, “রায়ে আমি এবং আমার পরিবার খুবই খুশি। ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশনের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি স্বাধীনতার এত বছর পর এই আসামিদের বিচার করার জন্য। সরকারের কাছে অনুরোধ জানাব, পলাতক আসামিদের ধরে তাদের সাজা কার্যকর করার জন্য। তবেই আমরা শহীদ পরিবারের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ শান্তি পাব “

সাত অভিযোগ

ট্রাইব্যুনালের বিচারে এ মামলার দুই আসামির বিরুদ্ধে আনা সাত অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিটি অভিযোগেই তাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। তবে সব মিলিয়ে সাজা কার্যকর হবে একটি।      

প্রথম অভিযোগ: হবিগঞ্জের লাখাই থানার কৃষ্ণপুর গ্রামে লুটপাট, অপাহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও গণহত্যা।

দ্বিতীয় অভিযোগ: হবিগঞ্জের লাখাই থানার চণ্ডিপুর গ্রামে লুটপাট, অপাহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও গণহত্যা।

তৃতীয় অভিযোগ: হবিগঞ্জের লাখাই থানার গদাইনগর গ্রামে লুটপাট, অপাহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও গণহত্যা।

চতুর্থ অভিযোগ: হবিগঞ্জের লাখাই থানার কৃষ্ণপুর, চণ্ডিপুর ও গদাইনগর এবং কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থানার সদানগর গ্রামে শ্মশানঘাটে গণহত্যা।

পঞ্চম অভিযোগ: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানার ফান্দাউক গ্রামের অপাহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।

ষষ্ঠ অভিযোগ: কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থানার সাবিয়ানগর গ্রামের চৌধুরী বাড়ির সামনের মাজারে হামলা চালিয়ে অপাহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা।

সপ্তম অভিযোগ: কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থানার সাবিয়ানগর গ্রামের খাঁ বাড়িতে হত্যা, লুটপাট।

দুই আসামি

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুসারে, একাত্তরে লিয়াকত ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন। মুসলিম লীগের সদস্য হিসেবে ফান্দাউক ইউনিয়নে রাজাকার বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘদিন পালিয়ে থেকে লিয়াকত পরে এলাকায় ফেরেন এবং আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এক সময় দলটির লাখাই থানা কমিটির সভাপতি হন। মামলার তদন্তকালেই লিয়াকত পালিয়ে যান বলে প্রসিকিউশনের ভাষ্য।

আর কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থানার আলীনগর গ্রামের রজব আলী ১৯৭০ সালে ভৈরব হাজী হাসমত আলী কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় ইসলামী ছাত্র সংঘের কলেজ শাখার সভাপতি হন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ভৈরবে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে তিনি অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন এবং পরে এলাকায় ফিরে আল বদর বাহিনী গঠন করেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটক হয়েছিলেন রজব। ১৯৭২ সালে তার বিরুদ্ধে দালাল আইনে তিনটি মামলা হয়েছিল, যাতে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়।

কিন্তু দালাল আইন বাতিলের সুযোগে ১৯৮১ সালে রজব ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হন। পরে ‘আমি আল বদর বলছি’ নামে একটি বই তিনি প্রকাশ করেন।

ওই বইয়ে রজবের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত অভিযোগের আত্মস্বীকৃতি রয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়।