রোববার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাজার হাজার মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও আলেমদের উপস্থিতিতে তিনি বলেন, “আজকে কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি এটা শুধু স্বীকৃতিই না। আমি মনে করি আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে এই মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করছে। শুধু তাই না। সব থেকে বড় কাজ আপনারা করছেন- যারা এতিম বা একেবারে হতদরিদ্র আপনারা তাদেরকে আশ্রয় দেন, খাদ্য দেন, শিক্ষা দেন। এর থেকে বড় কাজ আর কি হতে পারে। কাজেই সেই কাজে আপনাদের স্বীকৃতি দেব না সেটাতো কখনো কখনো হতে পারে।
কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির স্বীকৃতি দিয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে আইন পাস হয়। সেজন্য প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিতে এ মাহফিলের আয়োজন করে কওমির ছয় বোর্ডের সমন্বিত সংস্থা আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যাহ বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পর তার হাতে শুকরিয়ার স্মারক তুলে দেন আহমদ শফী। আর প্রধানমন্ত্রী এ সময় শফীর হাতে পাস হওয়া আইনের অনুলিপি তুলে দেন।
শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেন, “যখনই সরকারে এসেছি, আমরা চেষ্টা করেছি। শিক্ষা নীতিমালায় আমরা ধর্মীয় শিক্ষাকে স্বীকৃতি দিয়েছি। কারণ আমি মনে করি একটা শিক্ষা তখনই পূর্ণাঙ্গ হয় যখন ধর্মীয় শিক্ষা সেই সাথে গ্রহণ করা যায়। তখনই শিক্ষা পূর্ণ হতে পারে।”
আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যাহ বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় ১৩ লাখ ৬৮ হাজার শিক্ষার্থী আছে।
শেখ হাসিনা বলেন, “লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে। অথচ তাদের ডিগ্রির যদি স্বীকৃতি না থাকে তাহলে তারা কোথায় যাবে, কী করবে, কী করে তারা চলবে?
“আমরা আইন পাশ করে করে দিলাম। আমরা করে দিলাম, কিন্তু কাল কেউ ক্ষমতায় এলে আবার সাতাত্তর সালের মত বন্ধ করে দিতে পারে। বন্ধ যাতে না করতে পারে সেজন্যই আমরা এটা করেছি (আইন)।”
আহমদ শফীর সভাপতিত্বে সকাল ৯টায় কোরআন তেলওয়াতের মধ্য দিয়ে মাহফিলের সূচনা হয়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে প্রধানমন্ত্রী পৌঁছালে আহমদ শফী তাকে স্বাগত জানান।
আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যাহ বাংলাদেশের সদস্য মুফতি রুহুল আমিন কওমি সনদের স্বীকৃতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেন। বক্তাদের কেউ কেউ আহমদ শফীকে স্বাধীনতা পদক দেয়ারও দাবি জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, “যারা ইসলামের খেদমত করছেন তাদের মধ্যে উপস্থিত হতে পারা একটা সৗভাগ্যের বিষয়। আমাকে যখন আল্লামা শফী সাহেব বললেন, এই বিল পাস করার জন্য তিনি সংবর্ধনার আয়োজন করবেন। আমি বললাম, না, আমার জন্য সংবর্ধনা না। এটা হবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায়।
“আমি এটা বিশ্বাস করি যে, ইসলাম শান্তি, ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। আর সেই দ্বীন শিক্ষা যারা দেন তারা কেন অবহেলিত থাকবে! তাদের অবহেলিত থাকতে দেওয়া যায় না।”
তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন ও টঙ্গীতে ইজতেমার জন্য জায়গা দেওয়া, বাংলাদেশকে ওআইসির সদস্য করাসহ বিভিন্ন কাজের কথা তুলে ধরেন।
“কাজেই তাদের সবসময় আমরা সন্মান করি। কিন্তু জাতির পিতাকে হত্যা করে যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা ১৯৭৭ সালে কওমির স্বীকৃতিটা বাতিল করে দিয়েছিল।”
ধর্মের প্রতি নিজের অবিচল বিশ্বাসের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাকে কখনো গ্রেনেড হামলা, কখনো গুলি, কখনো বোমা- নানাভাবে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। আর আমি যে বারবার বেঁচে যেই এটা মনে হয় আল্লারই কোনো ইশারায়। আল্লাহ নিশ্চই আমাকে দিয়ে কোনো কাজ করাবেন, যে কারণে তিনি বারবার আমাকে রক্ষা করছেন।”
শেখ হাসিনা তার সরকারের সময়ে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট করে দেওয়া, নিরক্ষরতা দূর করার লক্ষ্যে মসজিদভিত্তিক উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার কথা তুলে ধরে বলেন, সমগ্র বাংলাদেশে ৫৬০টা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র ও আরবি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় করা হচ্ছে।
“আমরা সবসময় আমাদের নবী করিম (স.) এর পথ অনুসরণ করে চলি। ইসলাম ধর্মের মূল কথা শান্তি, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, অসাম্প্রদায়িক চেতনা। নবী করিম (স.) যে শিক্ষা দিয়েছেন সে শিক্ষা নিয়েই আমরা পথ চলব।
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মধ্যে হানাহানির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এতে লাভবান হচ্ছে যারা অস্ত্র বিক্রি করে। রক্ত যায় কাদের? মুসলমানদের।… মুসলিম উম্মাহকে এক হয়ে শান্তির পথে যেতে হবে। যদি কোনো ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে, সেটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা সমাধান করব।”
এ সময় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশের মাটিতে কোনো জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতির স্থান হবে না। বাংলাদেশ হবে শান্তিপূর্ণ, উন্নত, সম্মৃদ্ধশালী দেশ। যারা টেররিস্ট বা সন্ত্রাসী তাদের কোনো ধর্ম নাই, দেশ নাই, তাদের কোনো সমাজ নাই। যারা সত্যিকারের ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে তারা সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী হতে পারে না।”
আহমদ শফির মোনাজাতের মধ্যে দিয়ে শোকরানা মাহফিল শেষ হয়। তার আগে তার লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনানো হয় অনুষ্ঠানে।
সেখানে তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলামের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই তাদের বক্তব্য রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার সুযোগ নেই। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এসব বিষয়ে ‘বিভ্রন্তিমূলক অপপ্রচার’ চালানো হয় বলেও মন্তব্য করেন হেফাজতের প্রধান।
তবে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতেও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। কওমি মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নেব না। আইনের দ্বারাই বিচার করে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে দেব, যাতে কখনে তারা এ ধরনের অপপ্রচার চালাতে না পারে।… দেশের শান্তি বিঘ্নিত হোক তা আমরা চাই না। দেশে শান্তি থাকলেই উন্নতি হবে। উন্নতি হলে সবাই লাভবান হবে।”
এ সময় নিজের পরিবার ও দেশের সবার জন্য দোয়া চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আপনাদের দোয়া চাই, সামনে নির্বাচন আছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আছেন। তিনি যদি চান, তাহলে আবার বাংলাদেশের মানুষের খেদমত করার সুযোগ আমাকে দেবেন। আর না চাইলে দেবেন না। আমি সবকিছু আল্লাহর ওপরই ছেড়ে দিয়েছি।”
শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ মাহফিলে বলেন, “ইসলামকে অনেক লাঞ্ছিত-বঞ্চিত করেছে মওদুদীর শিষ্যরা। আপনারা মওদুদীর ইসলাম চান? না মদিনা সনদের ইসলাম চান?”
অন্যদের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।