তার জামিন প্রশ্নে রুল জারির তিন সপ্তাহ পরে এসে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি এস এম মজিবুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার আবেদনটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছে।
শহিদুল আলমের আইনজীবী সারা হোসেন এ ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন’ বললেও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির উল্লাহ আদালতের আদেশের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন।
আদেশের পর আদালত থেকে বেরিয়ে এসে সারা হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “তিন সপ্তাহ মামলাটি ঝুলিয়ে রেখে আউট অব লিস্ট করেছেন হাই কোর্ট।… এ মামলার এফআইআরে যে বক্তব্য আছে, তার কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ নাই। সেটা উনারা (বিচারক) দেখেছেন, তারপরও সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নাই।”
এখন কী করবেন জানতে চাইলে সার হোসেন বলেন, হাই কোর্টের অন্য কোনো বেঞ্চে তারা আবারও জামিন আবেদন নিয়ে যাবেন।
তিনি বলেন, “একটা মানুষকে জামিন দিলে কি পৃথিবী উল্টে যাবে? কী ভয় হচ্ছে? আদালতের দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেকের ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। বিচার যা হওয়ার হবে। বিচারতো কোর্টেই হবে। বিচার আর জামিন তো এক জিনিস না। ৯০ দিন হয়ে গেল উনারা এখনো জামিনের সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না!”
জামিন প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানিতে গত সোমবার আদালত নিরপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আল জাজিরায় দেওয়া শহিদুল আলমের সাক্ষাৎকার এবং তার ফেইসবুক লাইভের ভিডিও আদালতে দেখাতে বলেছিল রাষ্ট্রপক্ষকে। মূলত সেসব ভিডিওর ভিত্তিতেই ‘উসকানিমূলক মিথ্যা’ প্রচারের অভিযোগ এনে শহিদুলের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে এ মামলা হয়েছে।
আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী বৃহস্পতিবার সেসব ভিডিও দেখানোর ব্যবস্থা হলেও তদন্ত কর্মকর্তা আরমান আলী সেসব ভিডিও চালাতে পারছিলেন না। প্রায় ঘণ্টাখানেক চেষ্টার পর বড় পর্দায় ভিডিও দেখানো সম্ভব হয়।
ভিডিও দেখা শেষে আদালত মামলার এজাহার থেকে শহিদুল আলমের বক্তব্য উদ্ধৃত করে সে বক্তব্যের ভিডিও দেখাতে বলে।
আরমান আলী তখন বলেন, “এ ঘটনা নিয়ে শহিদুল আলমের অনেক ভিডিও আমাদের কাছে প্রিজার্ভ করা আছে। সব ভিডিও থেকে কনসাইজ (সারসংক্ষেপ) করে এফআইআরে তুলে ধরা হয়েছে।”
যে ভিডিওগুলো আদালতে দেখানো হয়েছে, সেগুলোর উৎস আদালত জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা মামলার বাদী মেহেদী হাসানের কাছ থেকে সেগুলো পাওয়ার কথা বলেন।
এফআইআরে যে ভিডিও লিংকগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়েছে কি না, ৯০ দিন হয়ে গেলেও তদন্ত কেন শেষ হচ্ছে না- সেই প্রশ্ন করেন বিচারক।
এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে বলেন, “আমরা আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলাসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ভিডিও আনতে বলেছিলাম। আপনারা পুরো ভিডিও দেখতে চাইলে তা আনা হবে। বাংলাদেশ থেকে আল জাজিরায় এভাবে কেউ ইন্টারভিউ দেয়নি, উনি দিয়েছেন।”
এরপর বেঞ্চের দুই বিচারক নিজেদের মধ্যে কিছু সময় কথা বলে আবেদনটি আউট অব লিস্ট করে তিন সপ্তাহ পরে আসতে বলেন।
শহিদুল আলমের আইনজীবী সারা হোসেন তখন বলেন, “এ মামলায় সবকিছু জব্দ করা হয়েছে, তদন্তও হচ্ছে বলা হয়েছে। তাহলে কেন তার জামিন হয় না? জামিনের বিষয়ে রুল দিয়ে তিন সপ্তাহ ঘুরিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তাদের লিখিত বক্তব্য জমা দেননি।
“তদন্ত শুরুর পর এক মাস হয়ে গেছে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনার পর শহিদুল আলমের জামিন বিষয়ে রুল দিয়েছেন, অথচ নিয়ম হল রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শোনার আগেই রুল দেওয়া। এরপরও গ্রেপ্তারের ৮৮ দিন পরে এসে জামিন না পেলে বিষয়গুলো মিডিয়ার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে যাবে। তখন দেশ ও দেশের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে “
এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এ সরকার আবার ফিরে আসবে না, এ ধরনের বক্তব্য যে লোকটা দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে তো রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হওয়া উচিৎ। তার জামিনের জন্য আদালতের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।”
এ সময় বিচারক সারা হোসেনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমরা কি জামিন বিবেচনা করি না? সকাল থেকে এখানে বিচার করতে বসে আমরা তো কত আবেদন বিবেচনা করি। আমরা তো আপনাদের আবেদন খারিজ করে দিচ্ছি না, আউট অব লিস্ট করছি।”
এরপর আদালত শহিদুল আলমের জামিন অবেদন কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়ার আদেশ দেয়।
পরে সারা হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “বিচারপতি নিজেই তদন্তকারীকে প্রশ্ন করছেন, যে বক্তব্য এফআইআর-এ দেওয়া হয়েছে, তা তদন্ত কর্মকর্তা দেখাতে পারেননি। তারপরও কেন জামিন আটকে রাখবেন!”
অন্যদিকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত উভয়পক্ষকে শুনে মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। তারা চাইলে ভিন্ন একটি বেঞ্চে যেতে পারেন কিংবা এই কোর্টেও আসতে পারেন।”
শহিদুলের আইনজীবীর বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, “আদালত কিন্তু দ্বিধা বিভক্ত আদেশ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিধাবিভক্ত আদেশ দিলে এ আবেদনটির শুনানিতে আরও বিলম্ব হবে ভেবে আউট অব লিস্ট করে দিয়েছেন। আদালত কিন্তু মানবিকভাবে দেখেছেন বিষয়টি। এখন তারা চাইলে এই কোর্টেও আসতে পারেন, আবার অন্য কোনো কোর্টেও যেতে পারেন।”
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় গত ৫ অগাস্ট শহিদুল আলমকে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার পর ‘উসকানিমূলক মিথ্যা’ প্রচারের অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় ৬ অগাস্ট রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
১১ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েস শহিদুল আলমের জামিন আবেদন নাকচ করেন। এরপর ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি হাই কোর্টে জামিন আবেদন করলে ৩ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়।
শুনানি শেষে গত ৭ অক্টোবর হাই কোর্ট শহিদুল আলমের জামিন প্রশ্নে রুল জারি করে। কেন জামিন দেওয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। এক সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
সেই রুলের শুনানিতেই গত সোমবার আদালত আল জাজিরায় দেওয়া সাক্ষাৎকার ও ফেইসবুক লাইভে শহিদুল আলমের বক্তব্যের ভিডিও দেখতে চায়। বৃহস্পতিবার তা দেখে ও তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য শুনে জামিন আবেদনটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছে আদালত।