খালেদা সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন: আদালত

জিয়া দাতব্য ট্রাস্টের নামে ‘ব্যক্তিগত’ তহবিলে অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে আদালত।

মাসুম বিল্লাহপ্রকাশ বিশ্বাস ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Oct 2018, 12:20 PM
Updated : 29 Oct 2018, 02:38 PM

সোমবার আলোচিত এই দুর্নীতি মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, খালেদা জিয়া “সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন থেকে অপরাধমূলক কাজের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ট্রাস্টের অনুকূলে অবৈধভাবে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা কখনো কাম্য হতে পারে না।”

সাত বছর আগে দুদকের করা এই মামলা রায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদাসহ চার আসামিকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে রায়ে। পাশাপাশি তাদের ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে আবুল হারিছ চৌধুরী বিএনপির গত শাসনামলে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। যিনি এ মামলায় বিচার শুরুর আগ থেকেই পলাতক রয়েছেন।

অপর দুই আসামি হারিছ চৌধুরীর তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান রয়েছেন কারাগারে।

খালেদা জিয়া ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের অনুপস্থিতিতে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের বসানো জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাস থেকে এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।

বিচারক আখতারুজ্জামান তার চার শতাধিক পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার আদালতে পড়ে শোনান।  সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৫টি বিষয়কে তিনি বিবেচনায় নিয়েছেন বলে জানান।

রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষ মামলার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।

বিএসএমএমইউতে সোমবার দুপুরে এনাটমি বিভাগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর কেবিনে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে খালেদা জিয়াকে। এদিন তার বিরুদ্ধে আরেকটি দুর্নীতির মামলায় সাত বছরের সাজার রায় হয়।

আর পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “ভবিষ্যতে যাতে অনুরূপ দায়িত্বে থেকে কেউ ওই ধরনের অপরাধ করতে উৎসাহিত না হন, সে জন্য ওই আসামিকে (খালেদা) কঠোর শাস্তি প্রদান করা অত্যাবশ্যক।

“অপর তিনজন আসামি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে আসামি খালেদা জিয়াকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ওই ধরনের অপরাধ করার কাজে সহায়তা করায় তাদেরকেও সম পরিমাণ শাস্তি দেওয়া যুক্তিসঙ্গত বলে এই আদালত মনে করে।”

দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ ২০১১ সালের ৮ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ চার জনের বিরুদ্ধে এই দুর্নীতি মামলা দায়ের করেন।

তেজগাঁও থানার এ মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।

রায়ে বিচারক বলেন, দাতব্য ট্রাস্টের নামে যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে সেটি ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা ট্রাস্টি খালেদা জিয়ারই বাসভবন। এছাড়া ট্রাস্টের অন্য কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়নি।

ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় মঈনুল রোডের ওই বাসা সে সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ‘সরকারি বাসভবনের মত’ ব্যবহার হত উল্লেখ করে আখতারুজ্জামান বলেন, “সেখানে সরকারি অনেক কাজ তিনি করেছেন। সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন এবং ব্যবহার করেছেন।”

তাছাড়া খালেদার সঙ্গে কেবল তার দুই সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো ট্রাস্টি হিসেবে থাকায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টকে ‘একান্ত ব্যক্তিগত’ ট্রাস্ট হিসাবে বরাণনা করেন জজ আদালতের বিচারক।

তিনি বলেন, “আউট অ্যান্ড আউট ব্যক্তিগত ট্রাস্ট হওয়ায় ব্যক্তিগত অর্থ দিয়েই এটি পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি।”

বিএনপির দলীয় তহবিল থেকে ৬ কোটি ১৮ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৯ টাকা দাতব্য ট্রাস্টে জমা হয়েছিল। আর তা দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়াই করা হয়েছিল বলে রায়ে উল্লেখ করেন বিচারক।

বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই টাকা দেওয়ার বিষয়ে কোনো প্রমাণ আসামিপক্ষ উপস্থাপন করতে পারেনি উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, “দলীয় চেয়ারপারসনের নির্দেশে কিংবা তার ক্ষমতা দেখিয়ে রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী দলীয় ব্যাংক হিসাব পরিচালনকারীদের মাধ্যমে ওই টাকা দাতব্য ট্রাস্টে জমা করেন।”

সুরাইয়া খানের কাছ থেকে ৪২ কাঠা জমি জিয়া দাতব্য ট্রাস্টের নামে কেনা হয়েছিল কি-না, তাও বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলেন বিচারক।

সাক্ষীদের বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত করে দিয়ে রায়ে বলা হয়, ট্রাস্টের অর্থ ব্যবহার করে সুরাইয়া খানের কাছ ছয় কোটি ৫২ লাখ ৭ হাজার টাকা মূল্যে ওই জমি কেনার কথা বলা হয়। পরে তাকে দলিল মূল্যের ১ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত অর্থ হিসেবে দেওয়া হয়। যদিও ওই জায়গায় ট্রাস্টের কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি।

বিচারক বলেন, এই সুরাইয়া খান দাতব্য ট্রাস্টের অন্যতম ট্রাস্টি তারেক রহমানের চাচি শাশুড়ি হওয়ায় ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে’ তাকে ওই টাকা দেওয়া হয় বলে সাক্ষ্যপ্রমাণে উঠে এসেছে।

সুরাইয়া খানকে দেওয়া ওই অর্থ ‘অবৈধ দখল উচ্ছেদে’ ব্যবহার করা হয়েছে বলে আসামিপক্ষ দাবি করলেও মামলার বিচারে তার প্রমাণ মেলেনি বলে জানান বিচারক।

তিনি বলেন, “খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। অন্য কোনো উপায় ব্যবহার না করে ট্রাস্টের জায়গার অবৈধ উচ্ছেদ ওঠাতে অর্থ খরচের বিষয়টি যৌক্তিক হতে পারে না।”

সোনালী ব্যাংকের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় শাখায় জিয়া দাতব্য ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে মেট্রো মেকারসের নামে যে টাকা জমা করা হয়েছিল, তা যে ওই প্রতিষ্ঠানের দেওয়া অর্থ নয়, মামলার বিচারে তা প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে জানানো হয়।

বিচারক বলেন, সোনালী ব্যাংকের ওই হিসাব দাতব্য ট্রাস্টের ম্যানেজিং ট্রাস্টি খালেদা জিয়ার একক স্বাক্ষরে পরিচালিত হত।

“ট্রাস্টের নামে অর্থ আদায় ও ব্যয়ের যেসব কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে, ম্যানেজিং ট্রাস্টি হিসাবে ‘সবকিছুই খালেদা জিয়া জানতেন। তার অগোচরে কোনো টাকা জমা হওয়ার কথা নয়। অন্য আসামির যোগসাজশে এসব টাকা আদায় করে তিনি ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট করেছেন। এমনকি তারা যেসব উদ্দেশ্যে ট্রাস্ট গঠন করেছিল, তার একটিও বাস্তবায়ন করেন নাই।”

রায়ে বলা হয়, আসামি মনিরুল ইসলাম খান ঢাকার তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সহকারী একান্ত সচিবের ক্ষমতা ব্যবহার করে মেট্রো মেকারসের নামে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ওই অ্যাকাউন্টে জমা করেছিলেন। ওই টাকার উৎস অজানা।

শাহজালাল ব্যাংক থেকে ওই টাকার পেমেন্ট অর্ডার করার ক্ষেত্রে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ‘হুমকি দেওয়া হয়েছিল’ বলেও কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তার সাক্ষ্যে উঠে আসে।

বিচারক বলেন, পচা সাবানের মালিক শরীফুল আলম পচা এই ট্রাস্টে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন বলে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাও সঠিক বলে মেনে নেওয়া যায় না।

 এই শরীফুল আলমকে তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে মৃত দেখানোয় মামলার যুক্তিতর্কের সময় বিতর্ক উঠেছিল। তদন্তের এ দুর্বলতার কারণে মামলাটি খারিজের দাবি জানিয়েছিল আসামিপক্ষ।

এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি একই বিচারক জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন।

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ওই মামলায় খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ পাঁচজনকে দশ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় ওই রায়ে।