‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর এই শিক্ষার্থীর ফল নিয়ে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল আলোচনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ভর্তি অফিসের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘ঘ’ ইউনিটের প্রথম ১০০ জনের তালিকায় থাকা অন্তত ৭০ জন ভর্তিচ্ছু তাদের নিজ নিজ ইউনিটে দেওয়া ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তিতে গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে নিলেও গত মঙ্গলবার ফল প্রকাশ করেছে।
ফল প্রকাশের পর ‘ঘ’ ইউনিটে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে প্রথম হওয়া জাহিদ হাসান আকাশকে নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।
মাইলস্টোন কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের বাণিজ্য শাখা থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ এই শিক্ষার্থী গত ২০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছেন।
ভর্তি পরীক্ষায় ১২০ নম্বরের মধ্যে ১১৪ দশমিক ৩০ নম্বর নিয়ে সম্মিলিত মেধা তালিকায় বাণিজ্য শাখা থেকে প্রথম হয়েছেন তিনি।
‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় তিনি বাংলায় পেয়েছেন ৩০ নম্বরের মধ্যে ৩০; আর ইংরেজিতে পেয়েছেন ৩০ নম্বরের মধ্যে ২৭ দশমিক ৩০।
এই জাহিদই এক মাস দুই দিন আগে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অধিভুক্ত 'গ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৩৪ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে অনুত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
'গ' ইউনিটের পরীক্ষা বাংলায় তিনি পেয়েছিলেন ৩০ নম্বরের মধ্যে ১০ দশমিক ৮; ইংরেজিতে ৩০ নম্বরের মধ্যে পেয়েছিলেন ২ দশমিক ৪০।
এক মাসের ব্যবধানে জাহিদের এই সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। যেহেতু ‘ঘ’ ইউনিটে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে, সন্দেহের তীর সে দিকেও।
বিষয়টি নিয়ে জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার বোন চিত্রনায়িকা শবনম ইয়াসমিন বুবলীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তার সাড়াও মেলেনি।
জাহিদ যে কোচিং সেন্টারে কোচিং করতেন, সেই ইউনিভার্সিটি কোচিং সেন্টারের (ইউসিসি) কর্মকর্তারাও তার ফল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
ইউসিসির পরিচালক কামাল পাটোয়ারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সে উত্তরা শাখায় কোচিং করত। ফল প্রকাশের পর আমাদের এখানে তাকে আনা হয়েছিল। তাকে শুভেচ্ছা জানানোর একটি ভিডিও আমরা তুলেছিলাম। কিন্তু নানা কথা ওঠার পর আমরা তা সরিয়ে নিয়েছি।”
তিনি বলেন, “বিষয়টি আমাদের কাছেও সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। যে ছেলে ‘গ’ ইউনিটের পরীক্ষায় ইংরেজিতে ফেল করেছে, সে কী করে ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষায় এত নম্বর পায়।”
জাহিদের এমন নম্বর পাওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান মঙ্গলবার বলেছিলেন, “ওটা দিয়ে কিছু মূল্যায়ন করা যায় না। যে কনটেক্সটে পরীক্ষা হয় সেটা নিয়ে বেশি কিছু বলার সুযোগ আমাদের নাই। কারণ কার অর্জন কখন কী হয়, সেটা বলা খুব কঠিন।”
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও 'ঘ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার সমন্বয়ক অধ্যাপক সাদেকা হালিম বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ভাইভা তো নেবই। সেখানে আমাদের নিজস্ব মেকানিজম রয়েছে।
“যারা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে, তাদেরকে আমরা নিজস্ব কৌশল অনুযায়ী সনাক্ত করব। ধরা পড়া মাত্রই ভর্তি বাতিলের পাশাপাশি আমরা তাদের আইনের হাতে তুলে দেব।”
এবার 'ঘ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ভর্তির যোগ্য বিবেচিত হয়েছেন ২৬ দশমিক ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী; যা আগের বছরের দেড় গুণের বেশি।
২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে পাসের হার ছিল ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। তার পরের বছর ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে তা ছিল ১৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
পাসের হারের এমন অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিষয়ে উপাচার্য মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “এটা একেবারেই সত্য আমাদের অন্যান্য যে ইউনিটগুলো, সেই ইউনিটের দ্বিগুণ কিন্তু। এটা দেখার পরে, জানার পরে আমাদের প্রশ্ন ছিল, এটা ডিন ম্যাডাম ভালো বলতে পারবেন।
“যতটুকু আমি অবগত হয়েছি, সেটা হল বিশেষ করে ইংলিশ এবং বাংলাদেশ অ্যাফেয়ার্স এই দুটোর প্রশ্ন তুলনামূলকভাবে বেশ সাবলীল এবং সেটিতে ভালো নম্বর পেয়েছে। ফলশ্রুতিতে এটি ঘটেছে।”
তবে ‘ঘ’ ইউনিটে পাসের হারে এই ঊর্ধ্বগতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে; এই পরীক্ষা বাতিলের দাবিও উঠেছে।
ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়ায় প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রদল। পরীক্ষা বাতিল করে তা পুনরায় নেওয়ার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক বাশার সিদ্দিকী বুধবার এক বিবৃতিতে প্রশ্নফাসের জন্য ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি কমিটির সবাইকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।
ফল বাতিলের দাবিতে অনশন
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠায় 'ঘ' ইউনিটের পরীক্ষার ফল বাতিলের দাবিতে আমরণ অনশন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আখতার হোসেন।
আগের দিনের মতো মঙ্গলবার দুপুর থেকে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অনশনে বসেন তিনি।
আখতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে এমন কয়েকজন ছোটভাইকে পড়াতাম। তারা যখন আমাকে প্রশ্ন করেছে, 'ভাইয়া আপনাদের ওখানে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, তাহলে আমরা কি চান্স পাব না? আমাদের সাথে এমন অনায্য আচরণ কেন করা হল?'
“তাদের এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি। তাই বিচার চাইতে এখানে বসলাম। আমি চাচ্ছি, এই ভর্তি প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে এবং নতুন করে পরীক্ষা নিতে হবে।"
তিনি বলেন, “আমার তিনটি দাবি আছে। সেগুলো হচ্ছে, প্রথমত প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা দিতে হবে; দ্বিতীয়ত এ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জালিয়াতি করে যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের সবাইকে বহিষ্কার করতে হবে; তিন নম্বর দাবি হচ্ছে এপর্যন্ত যারা প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত ছিলেন তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং কঠোর শাস্তি দিতে হবে।”
আখতারের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ছাত্রলীগ। বুধবার রাতে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে এই শিক্ষার্থীকে সমর্থনের কথা জানান। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি।
পরে অনশনরত শিক্ষার্থীকে দেখতে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন।
তিনিও বলেন, “অনশনরত শিক্ষার্থীর সাথে আমরা নৈতিক একাত্মতা ঘোষণা করছি। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীও যেন জালিয়াতি করে ভর্তি হতে না পারে৷ আমরা চাই এ সমস্যার সমাধান হোক। আমরা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান জানাব।"
কোটা আন্দোলনকারীদের হুঁশিয়ারি
'ঘ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় নেওয়ার দাবিতে আমরণ অনশনে বসা আখতার হোসেনের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে কোটা সংস্কারের আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা।
এই পরীক্ষা বাতিল না হলে আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দেন তারা। পুনরায় নেওয়ার দাবিতে বৃহস্পতিবার রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন করবেন বলেও তারা জানান।
পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেন বলেন, “আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ঘ ইউনিটের বিতর্কিত পরীক্ষা পুনরায় নেওয়ার অনুরোধ জানাই। অন্যথায় সারা বাংলার ছাত্রসমাজ তীব্র আন্দোলন সৃষ্টি করে দাবি আদায় করবে৷"
আরেক যুগ্ম-আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নুরুল হক নূর বলেন, "প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ এর আগেও এসেছে। ব্যর্থতা ঢাকতে কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে পরীক্ষা নেয়নি, বরং ফল প্রকাশ করেছে৷
“নৈতিক জায়গা থেকে আমরা দাবি জানাই, পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় নেওয়া হোক৷ যদি তা না হয়, তাহলে আমরা পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি দেব।”