বিস্ফোরক পরিদপ্তর এবং রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, এসব সিলিন্ডারের মধ্যে কোনটিতে ত্রুটি তৈরি হয়ে থাকলে যে কোনো সময় ঘটতে পারে প্রাণঘাতি দুর্ঘটনা।
২০০৫ সালের সিএনজি বিধিমালা অনুযায়ী, পাঁচ বছর পরপর সিএনজিচালিত যানবাহনের সিলিন্ডার পরীক্ষা করা বাধ্যবাধকতামূলক। পরীক্ষায় ত্রুটি ধরা পড়লে নতুন সিলিন্ডার বসাতে হবে।
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) হিসাব অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত সারাদেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ তিন হাজার ১৩১টি।
এর মধ্যে দুই লাখ ৬৯ হাজার ৫০৬টি যানবাহন সিএনজি ব্যবহারের জন্য রূপান্তরিত। এক লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি অটোরিকশা এবং ৪০ হাজার ৩৮৩টি বাহন গ্যাসচালিত বাহন হিসেবে আমদানি করা হয়েছে।
২০১৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত যেসব বাহন রূপান্তরিত এবং নিবন্ধিত হয়েছে, সেগুলোর সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার সময় হয়েছে এ বছরের জুনে।
সিলিন্ডার পরীক্ষা কেন
২০০৫ সাল থেকে যানবাহনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মত দুর্ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করছে আরপিজিসিএল। সেখানে দেখা যায়, সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে ২০০৫ সালে দুটি, ২০০৬ সালে সাতটি, ২০০৭ সালে সাতটি, ২০০৮ সালে আটটি, ২০০৯ সালে পাঁচটি, ২০১০ সালে পাঁচটি, ২০১১ সালে ছয়টি, ২০১২ সালে পাঁচটি, ২০১৪ সালে ১০টি, ২০১৬ সালে চারটি এবং ২০১৭ সালে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতের তথ্য আরপিজিসিএলের কাছে নেই।
এ বছরের ১৭ জুলাই টাঙ্গাইলে একটি মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তিন জনের মৃত্যু হয়। এর আগে ৩ জুন নোয়াখালীতে একটি অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একজন মারা যান।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার সময় নিয়মিত যে সংকোচন-প্রসারণ হয়, তার ফলে সিলিন্ডারের সহনীয়তার মাত্রা কমে যায়। ঠিকমত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ডেন্টিং পেইন্টিং নস্ট হয়ে সিলিন্ডারে ক্ষয় হয়,পুরুত্ব কমে যায়। এছাড়া সিলিন্ডারের ভাল্বের কার্যক্ষমতাও অনেক সময় কমে যায়।
উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, একটা রাবার টানলে বড় হয়, ছেড়ে দিলে আবার আগের জায়গায় চলে যায় এটা আমরা দেখি। কিন্তু এটা কিন্তু আগের জায়গায় যায় না। স্থায়ী সম্প্রসারণ কিছুটা থেকে যায়।
“যদি পার্মানেন্ট এক্সপানশন হয়, সেটা খারাপ। যদি আগের জায়গায় চলে যায় তাহলে ভালো। কোনো সিলিন্ডারের স্থায়ী প্রসারণ যদি ওই সিলিন্ডারের আসল আয়তনের ৫ ভাগের বেশি হয়, তাহলে সেটা ব্যবহারের অনুপযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।”
ত্রুটিযুক্ত কোনো সিলিন্ডার পরীক্ষার বাইরে থালে তাতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে হুঁশিয়ার করেন আরপিজিসিএলের মহাব্যবস্থাপক।
“সিলিন্ডারে তিন হাজার পিএসআই চাপে গ্যাস ভরা হয়। আর রান্নাঘরের চুলায় গ্যাসের চাপ এক পিএসআইয়ের চেয়েও কম। চুলার ভাল্ব খুলে দিলে দেখবেন আগুনটা কত উপরে যায়। তাহলে বুঝুন সিলিন্ডারের গ্যাসের চাপ কতগুণ বেশি। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বিস্ফোরণটা কেমন হবে সেটা এ থেকে ধারণা করা যায়।”
পরীক্ষা করে ত্রুটিযুক্ত সিলিন্ডার বদলে নিলে এ ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে জানান আরপিজিসিএলের মহাব্যবস্থাপক।
সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা করা হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব কার জানতে চাইলে আরপিজিসিএলের মহাব্যবস্থাপক মহম্মদ আলী বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিআরটিএকে।
“প্রতিটি গাড়িকে ফিটনেসের জন্য প্রতি বছর বিআরটিএতে যেতে হয়। সিএনজিচালিত প্রতিটা গাড়ির ফিটনেস নবায়ন করার সময় সিলিন্ডার টেস্ট সার্টিফিকেট পরীক্ষা করে দেখতে হবে। ওই সার্টিফিকেট দেখাতে না পারলে ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন করা যাবে না। কিন্তু এটা ঠিকমতো করা হচ্ছে না।”
তিনি বলেন, বিআরটিএ যদি সিলিন্ডার টেস্ট সার্টিফিকেট ঠিকভাবে পরীক্ষা করত, তাহলে এক বছরের মধ্যেই সব গাড়ির সিলিন্ডার পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার কথা।
“কিন্তু আমরা সন্দিহান, এই প্রক্রিয়াটা পুরোপুরি দেখা হচ্ছে না অথবা সার্টিফিকেট যদি দেখিয়ে থাকে সেগুলো জাল হতে পারে।”
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক মো. সামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সিএনজি রূপান্তর কারখানা, ফিলিং স্টেশন এবং রি-টেস্টিং সেন্টারগুলোর অনুমতি তারা দেন। কিন্তু যানবাহনগুলোকে সিলিন্ডার পরীক্ষা করতে তারা বাধ্য করতে পারেন না।
গাড়িতে থাকা সিলিন্ডারের মেয়াদ এবং কার্যক্ষমতা আছে কি-না তা নিশ্চিত হতে ২০১৬ সালের ২৮ জুন একটি সার্কুলার জারি করেছিল বিআরটিএ।
বিআরটিএর পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই সার্কুলারে বলা হয়, আরপিজিসিএল অনুমোদিত ‘সিএনজি সিলিন্ডার টেস্টিং’ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা করে তা ব্যবহারের উপযুক্ত কিনা, বা মেয়াদ পেরিয়ে গেছে কি না- সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া আবশ্যক।
অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া প্রতিবেদন পরীক্ষা করার পর ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন করার কথা বলা হয় ওই সার্কুলারে।
গত বৃহস্পতিবার বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়,ফিটনেস নবায়ন করতে ফিটনেস সার্টিফিকেটের মূল কপি, ট্যাক্স টোকেনের ফটোকপিসহ বিভিন্ন কাগজপত্র চেয়ে একটি তালিকা টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার সনদের কথা বলা নেই।
ঢাকার কাফরুল থেকে মিনিবাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন করতে আসা জয়নাল আবেদীন জানালেন, তার গাড়িতে সিলিন্ডার বসানো হয়েছে ২০০৬ সালে ।
সিলিন্ডারটি পরে আর পরীক্ষা করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি তার ‘মনে নেই’।
“গতবছর ফিটনেস সনদ নবায়নের সময় এ ধরনের সার্টিফিকেট বিআরটিএ থেকে চায়নি। এবছরও এ বিষয়ে বিআরটিএর কর্মকর্তারা কিছু বলেননি।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিআরটিএর পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফিটনেস নবায়নে সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার সনদ দেখার জন্য আদেশ জারি করে প্রতিটি কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছেন তারা।
“আমরা সারাদেশের কার্যালয়গুলোয় আরও দুয়েকবার তাগিদ দিয়েছি। আমরা আরপিজিসিএল থেকে পাওয়া রি-টেস্টিং সেন্টারের তালিকাও দিয়েছি। বলেছি যেন বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন করে। এটি মানা হচ্ছে না বলে আমাদের কাছে কোনো রিপোর্ট নাই। যদি কোনো রিপোর্ট পাই আমরা ব্যবস্থা নেব। দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শকের শাস্তি হবে।”