২০ দলীয় জোটের বাইরে কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি যুক্ত হওয়ার তিন দিনের মাথায় এই ঘোষণা দিল দল দুটি।
বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে মঙ্গলবার গুলশানে একটি কমিউনিটি সেন্টারে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আসেন বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও এনডিপির চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মর্তুজা।
ছয় বছরের জোটসঙ্গী দুটি দলের আকস্মিক সম্পর্কোচ্ছেদের ঘোষণায় বিস্মিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০ দলের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে বলে তারা মনে করেন।
প্রয়াত রাজনীতিক মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নাতি জেবেল গানি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি যোগ দেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “ঐক্যফ্রন্ট গঠন নিয়ে যাদের অগ্রণী ভূমিকা দেখা যাচ্ছে, তাদের প্রায় সবাই ১/১১ এর অরাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাদের অনেকেই মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
“এমনকি বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখন যেই মামলায় কারাগারে রয়েছেন, সে মামলা দায়েরের নেপথ্য নায়করা আজ বিএনপির পাশে।”
এক প্রশ্নের জবাবে গানি বলেন, জোটনেত্রী খালেদা জিয়া আট মাস আগে কারাগারে যাওয়ার পর জোটের ব্যানারে কোনো কর্মসূচি করতে না পেরে তারা ‘ব্যথিত’।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে গণফোরাম সভাপতি কামালের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি ছাড়াও রয়েছে আ স ম আবদুল রবের জেএসডি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য।
এই জোট গঠনের উদ্যোগে সক্রিয় রয়েছেন সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মইনুল হোসেন। এই জোট গঠনে সক্রিয় ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মো. মনসুর আহমেদও জরুরি অবস্থার সময় সংস্কাপন্থি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে মান্নার মতো আওয়ামী লীগে স্থান হারিয়েছিলেন।
এক সময়ের সহকর্মী কামাল হোসেনকেও অগণতান্ত্রিক সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে দেখেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা বলছেন, নতুন এই জোটের আত্মপ্রকাশের উদ্দেশ্যও ষড়যন্ত্র করা।
গানি বলেন, “আমাদের আতঙ্ক এই কারণে যে, শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আমরা কি আরেকটি অগণতান্ত্রিক অশুভ শক্তিকে ক্ষমতায় আনার ষড়যন্ত্রের অংশ হতে যাচ্ছি?”
নির্দলীয় সরকারের অধীনে আন্দোলন জোরদারের লক্ষ্যে ২০১২ সালে চারদলীয় জোটের পরিসর বাড়িয়ে ১৮ দল গঠন করেছিল বিএনপি, তখন এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপি। পরে আরও দুটি দল যোগ দিলে তা ২০ দলীয় জোট নামে পরিচিতি পায়।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল ২০ দল। ওই দাবিতে সরকারের সাড়া না মেলার পাশাপাশি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে কারাগারে যাওয়ার পর আন্দোলনে জোরদারের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয় বিএনপি।
গত শনিবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর সোমবার রাতে ২০ দলের বৈঠক হয়েছিল। তাতে জোটের পক্ষ থেকে বিএনপির অবস্থানে সমর্থনের কথা জানানো হলেও পরদিনই দুটি দল জোট ছাড়ল।
২০ দলীয় জোটের সোমবারের বৈঠকে গানি কিংবা মর্তুজা ছিলেন না। দুই দলের মহাসচিব প্রতিনিধিত্ব করেন ওই বৈঠকে।
মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে গানি ও মর্তুজার সঙ্গে বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূইয়া ও এনডিপির মহাসচিব মন্জুর হোসেন ঈসাও ছিলেন। তবে সংবাদ সম্মেলনে তারা কেউ কথা বলেননি। শুধু গানিই কথা বলেন।
বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা যে আচরণ করেছেন, তাও ‘রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত’।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হয়ে বিএনপি তার রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপি নেতারা।
গানি অভিযোগ করেন, বিএনপি নতুন জোটে যাওয়ার বিষয়ে সব সময় ২০ দলীয় জোট শরিকদের ‘অন্ধকারে রেখেছিল‘।
“জাতীয় নির্বাচনের সময় খুব কাছাকাছি হলেও বিএনপি সেই বিষয়ে শরিকদের পরিষ্কার করছে না। বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা করতে চাইলে তারা কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে এক-এগারোর কুশীলবদের সঙ্গে যখন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তখন আমরা মনে করি, বিএনপি তার সকল নৈতিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত।”
বিএনপির কাছ থেকে অবহেলা পাওয়ার অভিযোগও করেন দল দুটির নেতারা। সংসদ নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির সাড়া না পাওয়ার কথাও বলেন তারা।
গানি বলেন, “বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলাম। মতপার্থক্য ও মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও জোটের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সব সময় আন্তরিক ছিলাম।
“এমনকি ২০১৪ সালের নির্বাচনে নানা ধরনের লোভনীয় প্রস্তাব থাকার পরও জোট ত্যাগ করি নাই। এই ত্যাগকে বিএনপি মূল্যায়ন করেনি। ভাবখানা এরকম যে আমরা কোথায় যাব?”
আওয়ামী লীগ থেকে কোনো প্রস্তাব পেয়েছেন কি না- জানতে চাইল গানি বলেন, “কোনো দল আমাদের কাছে তালিকা চায়নি। মহাজোট থেকেও কোনো অফার পাইনি। আমরা এই মুহূর্তে পর্যবেক্ষণ করতে থাকব।”
তবে বিএনপি জোটের পুনরায় ফেরার পথও রাখছেন গানি। তিনি বলেন, “আমরা বিএনপির বর্তমান যেইসব কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করছি, এগুলো থেকে তারা ফিরলে আবারও তাদের সঙ্গে ঐক্য সম্ভব।”
বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপির জোট ছাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ২০ দলের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম বলেন, “আমরা সব সিদ্ধান্ত জোট নেতাদের জানিয়েই নিয়েছি। গতকালের বৈঠকেও তো দল দুটির শীর্ষ নেতারা ছিলেন। এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সবাই সম্মত হয়েছে।”
মূল্যায়ন নিয়ে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “উনারা দুটি দলের শীর্ষ নেতা। আসন তো তারা পেতেই পারেন। তবে এখনও তো নির্বাচনের তফসিলও হয়নি। আসন বণ্টন নিয়ে কোনো আলোচনাও তো শুরু হয়নি।”
“আমার মনে হয়, আসন বণ্টন এখানে বিষয় না, এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে বলে আমরা মনে করি,” নিজের সন্দেহের কথা জানান বিএনপি নেতা নজরুল।
বাংলাদেশ ন্যাপ ইসিতে নিবন্ধিত দল হলেও এনডিপির নিবন্ধন নেই।