দেবী বোধনে শুরু উৎসবের

নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে মহাষষ্ঠী তিথিতে বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হল বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2018, 03:26 PM
Updated : 15 Oct 2018, 03:26 PM

সোমবার সকালে সারা দেশে মণ্ডপে মণ্ডপে হয়েছে বোধন; দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজা। বিহিতপূজার পর দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় মূল দুর্গোৎসবের।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবর্তী বলেন, “সন্ধ্যায় ষোড়শ উপচারে দেবীর আবাহন করেছি আমরা। সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজার মাধ্যমে শুরু হয়েছে মূল আচার।”

তিনি বলেন, “বিল্ববৃক্ষ (বেলগাছ) মহাদেবের ভীষণ প্রিয়, পদ্মযোনী ব্রহ্মাও বিল্ববৃক্ষে দেবীকে প্রথম দর্শন করেন। তাই আমরা দেবীকে বিল্ববৃক্ষ তলেই আবাহন করছি। আজ বিল্ববৃক্ষ তলে দেবী আবাহনের মধ্যে সংকল্প করেছি, দশমী পর্বন্ত যথাবিধ উপায়ে আমরা মায়ের পূজা করব।”

দেবীপক্ষের সূচনা হয় আশ্বিন শুক্লপক্ষের অমাবস্যার দিন; সেদিন মহালয়া। আর দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিনে কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপূজার মধ্যে দিয়ে। এর মাঝে ষষ্ঠ দিন, অর্থাৎ ষষ্ঠীতে বোধন। আর দশম দিন, অর্থাৎ দশমীতে বিসর্জন। দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা এই পাঁচদিনই চলে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, তিন অবতারের আবির্ভাবকাল ত্রেতাযুগে ভগবান রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গার সাহায্যে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন তিনি। দেবীর সেই আগমণের সময়ই দুর্গোৎসব।

রাম শরৎকালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন বলে এ পূজা শারদীয় দুর্গাপূজা নামেও পরিচিত। আর মর্ত্যলোকে আসতে দেবীর সেই ঘুম ভাঙানোকে বলা বলা হয় অকাল বোধন।

মহাষষ্ঠীতে রাজধানীর বনানী পূজামণ্ডপে দেবী দুর্গা। সোমবার সন্ধ্যার ছবি। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

পুরোহিতরা বলছেন, দুর্গা দেবীর প্রকৃত আগমনের সময় চৈত্র মাস। অর্থাৎ বসন্ত কাল। চৈত্র মাসে যে দুর্গাপূজা হয় তাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা। তবে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে শারদীয় পূজাই সবচেয়ে বড় উৎসব।

হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। আশ্বিন শুক্লপক্ষের এই ১৫টি দিন দেবীপক্ষ, মর্ত্যলোকে উৎসব।

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে, শুক্রবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের দুর্গোৎসবের। একটি বছরের জন্য ‘দুর্গতিনাশিনী’ দেবী ফিরে যাবেন কৈলাসে দেবালয়ে।

হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, এবার দেবী দুর্গা আসছেন ঘোটকে (ঘোড়ায়) চড়ে, যাবেন দোলায় (পালকি) চেপে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবর্তী বলেন, “শাস্ত্র অনুযায়ী দেবী ঘোড়ায় চড়ে এলে তার ফল হয় ‘ছত্রভঙ্গসরঙ্গম’, অর্থাৎ সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রে অস্থিরতার প্রকাশ পাবে। রাজনৈতিক উত্থান, পতন, সামাজিক স্তরে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, দুর্ঘটনা, অপমৃত্যুর প্রভাব বাড়বে।

“আর দেবী দোলায় চেপে বিদায় নিলে ফল হয় ‘দোলায়াং মরকং ভবেৎ’, অর্থাৎ দেখা দেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়।”

মহাষষ্ঠী তিথিতে দেবী দুর্গার আরাধনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমন ও গমনের বিষয়টি মাথায় রেখে ‘বিশেষ প্রার্থনা’ করা হবে বলে জানান রঞ্জিত চক্রবর্তী।

“মায়ের আগমন ও গমনের ধরন দুইয়েতেই বিপদের শঙ্কা। তবে আমরা বিশেষ প্রার্থনা করব, মা যেন আমাদের পৃথিবীকে সব অনাচার, অন্যায়  আর ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। তিনি রক্ষাকর্ত্রী, তিনি আনন্দময়ী।  তার মাতৃরূপের বন্দনায় আমরা কৃপা প্রার্থনা করব।”

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত বলেন, “দেবীপক্ষের সূচনালগ্নেই ঘোষিত হয়েছে আনন্দময়ীর আগমনী বার্তা। বাঙালি জীবনাচরণে ধর্মাচরণ স্ব স্ব সম্প্রদায়ের হলেও এ উৎসবের ব্যাপ্তি সার্বজনীন। বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারায় শারদীয় দুর্গোৎসব কেবলমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়, এটি বাংলাদেশের মানুষের। পূজার মাধ্যমে আমরা সার্বজনীন ধারাকেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”

দশভূজা দুর্গার শক্তি রূপের আরাধনায়  সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এবার ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সহিংসার বিনাশ চেয়ে ‘বিশেষ প্রার্থনা’ করবেন বলেও জানান মিলন।

১৬ অক্টোবর সকালে নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপনের পর শুরু হবে মহাসপ্তমীর পূজা। ১৭ অক্টোবর মহাঅষ্টমী পূজা, সেদিন হবে সন্ধিপূজা। রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে হবে কুমারী পূজা।

১৯ অক্টোবর সকালে বিহিত পূজার মাধ্যমে হবে মহানবমী পূজা। ২০ অক্টোবর সকালে দর্পন বিসর্জনের পর প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হবে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।

মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানী পূজামণ্ডপে নৃত্য পরিবেশন করেন শিল্পীরা। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

২০ অক্টোবর বিকাল ৩টায় রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে বের হবে মূল শোভাযাত্রা। পরে নগরীর ওয়াইজঘাট, তুরাগ, ডেমরা, পোস্তগোলা ঘাটে হবে প্রতিমা বিসর্জন।

ঢাকা মহানগরীতে ২০ অক্টোবর রাত ১০টার মধ্যে নিরঞ্জন (প্রতিমা বিসর্জন) সমাপ্ত করার নির্দেশনা দিয়েছে পূজা উদযাপন পরিষদ।

দুর্গোৎসব উপলক্ষে কক্সবাজারে কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হিন্দু রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্য পূজার আয়োজন করেছে সরকার। 

উৎসব উপলক্ষে মন্দিরে আরতি ও সংগীত প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিশেষ প্রসাদ বিতরণ করা হবে উল্লেখযোগ্য মণ্ডপগুলোতে।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য মতে, এ বছর সারা দেশে ৩১ হাজার ২৭২টি মণ্ডপে দুর্গোৎসব হচ্ছে, যা গতবারের তুলনায় ১১৯৫টি বেশি। এর মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে ২৩৪টি মণ্ডপ।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও প্রতিমা ভাংচুরের ধারাবাহিকতায় পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা শঙ্কা প্রকাশ করলে পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।