জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা, তদন্তে ডিবি

সময় টিভির এক আলোচনা অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধানকে নিয়ে মন্তব্যের জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে এক সেনা কর্মকর্তার করা জিডি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় পরিণত হতে যাচ্ছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2018, 10:11 AM
Updated : 16 Oct 2018, 03:57 PM

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (দক্ষিণ) ইতোমধ্যে এর তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তে উপাদান পাওয়া গেলে আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হবেন জাফরুল্লাহ।

এছাড়া আশুলিয়ায় জমি বিক্রিতে বাধ্য করার চেষ্টা এবং এক কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহসহ চারজনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে।

বিএনপি সমর্থক পেশাজীবী নেতা হিসেবে পরিচিত জাফরুল্লাহ নির্বাচন সামনে রেখে কামাল হোসেন ও বি চৌধুরীর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন।

গত ৯ অক্টোবর রাতে সেনাপ্রধানকে নিয়ে মন্তব্যে ‘ভুল ছিল’ স্বীকার করে জাফরুল্লাহ চৌধুরী দুঃখ প্রকাশ করলেও তার মূল বক্তব্য থেকে সরে আসেননি।  

ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবির হোসেন হাওলাদার জানান, সেনা সদরে দায়িত্বরত মেজর এম রকিবুল আলম গত শুক্রবার থানায় এসে ডা. জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে একটি জিডি করেন।

সেখানে বলা হয়, “২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়ের পূর্ব রাতে হঠাৎ করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে সেনাপ্রধান সম্পর্কে প্রদত্ত বক্তব্যটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বিদ্বেষপ্রসূত ও ষড়যন্ত্রমূলক, যা সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি তথা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।

“ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মত একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি কেন, কী উদ্দেশ্যে এবং কাদের প্ররোচনায় এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক, বানোয়াট ও অসত্য বক্তব্য টকশোতে বলেছেন, তা তদন্তের দাবি রাখে।”

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই জিডিটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হিসেবে গ্রহণের অনুমতি আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে পেয়েছি। মামলা তদন্তের জন্য ডিবিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”

৯ অক্টোবর রাতে সময় টিভির আলোচনা অনুষ্ঠান সম্পাদকীয়তে জাফরুল্লাহ চৌধুরী দাবি করেন, সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ যখন ‘চট্টগ্রামের জিওসি’ ছিলেন, সেখান থেকে ‘সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ চুরি’ যাওয়ার ঘটনায় তার ‘কোর্ট মার্শাল’ হয়েছিল।

এরপর বিষয়টি নিয়ে সেনা সদরের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়। সময় টিভি নিজেদের বক্তব্যসহ সেটি প্রচার করে।

প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, বর্তমান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ চাকরি জীবনে কখনোই চট্টগ্রামের জিওসি বা কমান্ড্যান্ট ছিলেন না। ওই সময় চট্টগ্রাম বা কুমিল্লা সেনানিবাসে কোনো সমরাস্ত্র বা গোলাবারুদ চুরি বা হারানোর ঘটনা ঘটেনি। জেনারেল আজিজ আহমেদ চাকরি জীবনে কখনো কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি হননি।

জাফরুল্লাহর বক্তব্যকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হিসেবে বর্ণনা করে সেনাসদরের প্রতিবাদ লিপিতে বলা হয়, ওই বক্তব্য “সেনাবাহিনী প্রধানসহ সেনাবাহিনীর মত রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে জনসম্মুখে হেয় করার হীন অপচেষ্টা মর্মে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয়।”

সেনাসদরের প্রতিবাদের পর গত শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, টেলিভিশনের আলোচনায় তার বক্তব্যে ভুল ছিল এবং সেজন্য তিনি দুঃখিত।

ভুল সংশোধন করে নিতে গিয়ে বিএনপি সমর্থক পেশাজীবী নেতা হিসেবে পরিচিত জাফরুল্লাহ বলেন, “জেনারেল আজিজ একজন দক্ষ আর্টিলারি সেনা কর্মকর্তা। তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি ছিলেন না, কমান্ডেন্টও ছিলেন না। তিনি তার কর্মজীবনের এক সময়ে চট্টগ্রাম সেনাছাউনিতে আর্টিলারী প্রশিক্ষক ছিলেন। তার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল হয়নি, একবার কোর্ট অব ইনকোয়ারি হয়েছিল।”

বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন কি না- জানতে চাইলে জাফরুল্লাহ বলেন, “খুব সহজ-সরলভাবে এখানে বলেছি, আমার শব্দচয়নে ভুল ছিল। এই ভুলের জন্য নিশ্চয়ই দুঃখ প্রকাশ করছি।”

সংবাদ সম্মেলনে তার ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে সোমবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে আরেকটি প্রতিবাদলিপি সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো হয়।

সেখানে বলা হয়,  ডা. জাফরুল্লাহ ‘কোর্ট অব ইনকোয়ারি’র যে কথা বলেছেন, সে তথ্যও ‘সঠিক নয়’।

“ব্যক্তি আজিজের বিরুদ্ধে কখনও কোর্ট মার্শালতো হয়নি, জেনারেল আজিজের সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য চাকরি জীবনে তার বিরুদ্ধে কোনো কোর্ট অব ইনকোয়ারিও হয়নি। বস্তুতপক্ষে ডা. জাফরুল্লাহর বক্তব্যটি চরম মিথ্যাচারের শামিল।”

সময় টিভিতে ‘ভুল, দায়িত্বজ্ঞানহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বক্তব্যের জন্য ভুল স্বীকার ও দুঃখ প্রকাশ করতে জাফরুল্লাহ পুনরায় ‘অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ও চতুরতার সাথে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন’ বলে অভিযোগ করা হয়েছে প্রতিবাদলিপিতে। 

সেখানে বলা হয়, জাফরুল্লাহ ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেডের উৎস হিসেবে ‘সুকৌশলে’ সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করার একটি চেষ্টা করেছেন, যা ‘দুরভিসন্ধিমূলক’।

“২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলা সংক্রান্ত মামলার রায় ঘোষণার আগের দিন টেলিভিশন লাইভ টকশোতে এ ধরনের অসত্য বক্তব্য প্রদান উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অসত্য বক্তব্যকে সংশোধন করার কোনো চেষ্টা করেননি।

“তার সামগ্রিক বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে তিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত সকল পদবীর সদস্যদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টার পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সেনাবাহিনী প্রধানের ভাবমূর্তি এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন।”

আশুলিয়ায় চাঁদাবাজির মামলা

রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার পর চাঁদাবাজির অভিযোগেও মামলা হয়েছে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে।

ঢাকার আশুলিয়ার পাথালিয়ায় জমি বিক্রিতে বাধ্য করার চেষ্টা এবং এক কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ এনে সোমবার রাতে মামলাটি হয়।

মানিকগঞ্জের মোহাম্মদ আলী নামে এক ব্যক্তির করা এই মামলায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য জাফরুল্লাহসহ মোট চারজনকে আসামি করা হয়েছে বলে আশুলিয়া থানার ওসি রিজাউল হক জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ব্যাপারে তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান দপ্তর এবং এই ট্রাস্টের অধীনে প্রতিষ্ঠিত গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাভারের আশুলিয়া থানা এলাকায় অবস্থিত।

মামলার বাদী মোহাম্মদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাথালিয়া মৌজার প্রায় চার একর ২৪ শতাংশ জমি তিনিসহ আরও দুজন ২০০৩ সালে কিনেছিলেন। ওই জমি নেওয়ার জন্য জাফরুল্লাহ ও তার লোকজন তাকে নানাভাবে ‘ভয়ভীতি‘ দেখিয়ে আসছে।

“তারা নাম মাত্র মূল্যে বিক্রির জন্য আমাকে এবং আমার শরিকদের চাপ দেওয়ার পাশাপাশি জীবননাশের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে।”

আলী বলেন, “তারা আমাদের জমি থেকে জোর করে প্রায় ৩০ লাখ টাকার মাটি কেটে নিয়ে গেছে। তাদের অত্যাচারে আমি এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি। এজন্য আমার বাইপাস সার্জারি করতে হয়েছে।”

এসব ঘটনায় সাভার ও আশুলিয়া থানায় আগে একাধিক জিডি করেন বলেও দাবি করেন আলী।

সর্বশেষ গত ১৪ অক্টোবরের এক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এজাহারে বলা হয়, “ওইদিন সকালে মোহাম্মদ আলী ও তার শরিক আনিছুর রহমান জমিতে থাকাবস্থায় জাফরুল্লাহর সহযোগী দেলোয়ার হোসেন (৫৭), সাইফুল ইসলাম শিশির (৫৫) এবং আওলাদ হোসেন (৪৮)সহ ৩/৪জন জমিতে ঢুকে জানায়, তারা জাফরুল্লাহ নির্দেশে এসেছে।

“তারা জমি তাদের কাছে বিক্রির জন্য বলে। সেই সঙ্গে বলে, এই জমি গণবিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পূর্বে না দেওয়ার কারণে তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এজন্য এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় তারা হুমকি দেয় এবং জমির কাঁটাতারের বেষ্টনি, সাইনবোর্ড ও একটি গেইট ভাংচুর করে।”