আগামী অধিবেশনেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের দাবি সম্পাদক পরিষদের

আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা সংশোধনের দাবিতে নজিরবিহীন এক পদক্ষেপে ঢাকার রাস্তায় মানববন্ধন করেছে মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2018, 08:31 AM
Updated : 15 Oct 2018, 07:14 PM

সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই মানববন্ধন থেকে সংসদের আগামী অধিবেশনেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধনের দাবি জানানো হয়েছে সরকারের কাছে।

দেশের ১৬টি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকরা ব্যানার হাতে প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে ১০ মিনিটের এই কর্মসূচিতে অংশ নেন।

তাদের অভিযোগ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মুক্ত গণমাধ্যমের পরিপন্থি।

সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ আনাম এ কর্মসূচিতে সাত দফা দাবি তুলে ধরে বলেন, “আমরা আশা করব, আমাদের এই দাবি সরকার গ্রহণ করবেন এবং এই সংসদের যে শেষ অধিবেশ আছে সেই অধিবেশনেই যথাযথ সংশোধনী এনে এই আইনটি সবার জন্য গ্রহণযোগ্য আইন উনারা করবেন।”

সম্পাদক পরিষদের সাত দফা দাবি হল-

১. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা যথাযথভাবে সংশোধন করা

২. বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনেই এসব সংশোধনী আনা

৩. পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে কোনো সংবাদ মাধ্যম প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালানোর ক্ষেত্রে তাদেরকে শুধু নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু আটকে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া যাবে, কিন্তু কোনো কম্পিউটার ব্যবস্থা বন্ধ করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। আর কেবল তখনই প্রকাশের বিষয়বস্তু আটকানো যাবে, যখন যখন ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়বস্তু আটকে দেওয়ার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারবে

৪. কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কোনো কম্পিউটার ব্যবস্থা আটকে দেওয়া বা জব্দ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই আদালতের অনুমতি নিতে হবে

৫. সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীদের সাংবাদিকতার দায়িত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য তাদের বিরুদ্ধে সমন জারি করতে হবে। সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীদের কোনো অবস্থাতেই পরোয়ানা ছাড়া ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা ছাড়া আটক বা গ্রেপ্তার যাবে না

৬. গণমাধ্যমের পেশাজীবীর বিরুদ্ধে মামলার গ্রহণযোগ্যতা আছে কিনা তার প্রাথমিক তদন্ত প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে করাতে হবে। সেজন্য প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করতে হবে

৭. তথ্য অধিকার আইনকে ‘দ্ব্যর্থহীনভাবে’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন “বিভিন্ন মন্ত্রী বলছেন আলোচনার দরজা বন্ধ হয়নি, আমরাও মনে করি না আলোচনার দরজা বন্ধ। তবে আলোচনার নামে প্রহসন যেন না হয়। আমরা আলোচনায় গেছি, আমরা অত্যন্ত বিশ্বাস নিয়ে গেছি। কিন্তু সেই বিশ্বাসের প্রতিফলন এখনও হয়নি।”

সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দাবি পূরণের আশা প্রকাশ করে মাহফুজ আনাম বলেন, “আমরা আলোচনা করতে চাই। তবে একটি গ্রহণযোগ্য আলোচনা, যেটা সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে, আলোচনা শুধু আলোচনার জন্য নয়।”

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকে এর বিভিন্ন ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিল সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। তাদের আপত্তির সুরাহা না করেই গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে ওই আইন পাস করা হয়।

এই প্রেক্ষাপটে ‘বাক স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতার পরিপন্থি’ আইন প্রণয়নের প্রতিবাদে ২৯ সেপ্টেম্বর মানববন্ধনের কর্মসূচি দেয় সম্পাদক পরিষদ। তবে পরে সরকারের অনুরোধে কর্মসূচি স্থগিত করে তারা সচিবালয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে বৈঠক করেন।

সেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নয়টি ধারা নিয়ে সম্পাদক পরিষদের আপত্তির বিষয়ে আলোচনা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, তাদের আপত্তির বিষয়গুলো মন্ত্রিসভায় আলোচনার জন্য তোলা হবে।

এরপর প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এক ফেইসবুক পোস্টে সম্পাদক পরিষদের কঠোর সমালোচনা করেন।

তিনি লেখেন, “পরিষ্কারভাবেই, তাদের নৈতিকতা বলে কিছু নেই। বস্তুতঃ সম্পাদক পরিষদ বলতে চায়, তাদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে নোংরা, মিথ্যা প্রচারণা চালাতে দিতে হবে এবং সত্য অবলম্বন না করেই তাদের অপছন্দের রাজনীতিকদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে দিতে হবে।”

তিনি প্রশ্ন রাখেন, সম্পাদকরা যদি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘এমন পরিকল্পনা’ করেন, তাহলে দেশের ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।

এরপর ৩ অক্টেবর এক সংবাদ সম্মেলনে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “উদ্বিগ্ন তারা বেশি হবে, যারা এতদিন ধরে খুব তৈরি হয়ে আছে,… নির্বাচনের কাছাকাছি… মানে আমাদেরকে ভালো করে ঘায়েল করার জন্য যারা খুব বেশি ডকুমেন্ট তৈরি করে বসে আছে বা একটা একটা করে ছাড়ছে…।”

এরপর গত অক্টোবর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে সই করলে তার আইনে পরিণত হয়।

বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনা না হওয়ায় সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘তিন মন্ত্রী কথা রাখেননি’।

এর ধারাবাহিকতায় স্থগিত রাখা সেই মানববন্ধন কর্মসূচি সোমবার পালন করে সরকারের কাছে সাত দফা দাবি তুলে ধরল সম্পাদক পরিষদ।

অন্যদের মধ্যে মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, নিউ এইজের সম্পাদক নূরুল কবীর, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, ইনডিপেনডেন্ট সম্পাদক এম শামসুর রহমান, ইনকিলাবের সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দীন, বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ঢাকা ট্রিবিউন সম্পাদক জাফর সোবহান, করতোয়া সম্পাদক মো. মোজাম্মেল হক, সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনিরুজ্জামান, যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম ও সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি এ কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন।