রোহিঙ্গাদের জন্য চাই ‘আগামীর দিশা’

নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সামনে এগোনোর মত দিশা না পেলে তা ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলে মত এসেছে এক আলোচনায়।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Oct 2018, 03:36 PM
Updated : 14 Oct 2018, 02:58 AM

জার্মানির আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টার ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল মনে করছেন, রোহিঙ্গাদের একটি প্রজন্ম যেন হারিয়ে না যায়, শিক্ষা আর কাজের সুযোগ পেয়ে তারা যেন জীবনের একটি অর্থ খুঁজে পেতে পারে, তা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আর বাংলাদেশে প্রথম ইন্টারনেট সংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা বিপুল সংখ্যক শিশুর মনের ক্ষত যদি উপশম করা না যায়, তারা যদি স্বাভাবিক মানুষের মত বড় হওয়ার ‍সুযোগ না পায়, তবে তা সমাজের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

একই সময়ে শরণার্থী সঙ্কটের মুখোমুখি জার্মানি ও বাংলাদেশের দুই সংবাদ মাধ্যমের দুই প্রধান সম্পাদক শনিবার ঢাকায় মুখোমুখি হয়েছিলেন এই আলোচনায়। দুই দেশে এ সঙ্কটের ধরন আর উত্তরণের চ্যালেঞ্জগুলো উঠে এসেছে তাদের কথায়।

ভাগ্য বদলের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপমুখী জনস্রোত চলছে গত কয়েক বছর ধরেই। মূলত আফ্রিকান এই অভিবাসন প্রত্যাশীদের ১০ লাখের বেশি ইতোমধ্যে আশ্রয় পেয়েছে জার্মানিতে।

 

অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশকে প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহন করতে হচ্ছে। এর মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে গতবছর অগাস্টে রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর, যাকে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে বর্ণনা করে আসছে জাতিসংঘ।

বাংলাদেশ সফরে এসে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির ঘুরে দেখেছেন জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক। শনিবার ঢাকায় ডয়চে ভেলের আয়োজনে এ আলোচনায় সেই অভিজ্ঞতার কথা তিনি বলেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণগুলো তুলে ধরেন। 

আলোচনার সঞ্চালনায় ছিলেন ডয়চে ভেলের এশিয়া বিভাগের প্রধান দেবারতি গুহ।

ইনেস পোল মনে করেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে একটি সুযাগ পাওয়া উচিত

ইনেস পোল বলেন, রোহিঙ্গা শিশুরা সুন্দর, স্মার্ট। তারা শিখতে চায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত ক্যাম্পে স্কুল স্থাপন করা; শিক্ষার উপকরণ সরবরাহ করা। তা না হলে রোহিঙ্গাদের একটি প্রজন্ম হারিয়ে যাবে।

আর সেটা ঘটলে বাংলাদেশ বা এ অঞ্চলের কারো জন্যই তা ‘ভালো হবে না’ বলে মনে করেন ইনেস পোল।

রোহিঙ্গারা যেন ভাষা শিখে, শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশেই নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে- সেই সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পশ্চিম জার্মানিতে ‘অতিথি শ্রমিক’ হিসেবে আসা জনগোষ্ঠীর প্রসঙ্গ টানেন ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক।

 

তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির পুনর্গঠনের জন্য প্রচুর কর্মীর প্রয়োজন ছিল। সে সময় তুরস্ক, ইতালি, স্পেন থেকে অনেকে শ্রমিক হিসেবে জার্মানিতে এসেছিলেন। তারা ভেবেছিলেন, এই প্রবাসী জীবন হবে সাময়িক।

এক সময় তারা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে জার্মানিতে ঘর বাঁধলেও জার্মান সমাজে একীভূত হতে পারেননি। জার্মানিকে এর জের টানতে হয়েছে বলে জানান ইনেস পোল। 

বাংলাদেশেও রোহিঙ্গাদের অবস্থান যে দীর্ঘায়িত হবে, সরকারকে তা মেনে নিয়ে রোহিঙ্গাদের সমাজের মূল ধারায় নিয়ে আসার পরামর্শ দেন তিনি, যাতে তারা শিক্ষা আর কাজের সুযোগ পায়।

রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, বাংলাদেশে তাদের অবস্থানের মেয়াদ ও তাদের ভবিষ্যতের প্রসঙ্গ বারবার ঘুরে ফিরে আসে এ আলোচনায়।

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের শুরু মিয়ানমারে, সেখানেই খুঁজতে হবে সামাধান

কিন্তু বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র জার্মানির সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছানোর চেষ্টায় থাকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বাস্তবতার যে অনেক ফাঁরাক, সে বিষয়টি মনে করিয়ে দেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে ‘সমস্যার উৎস’ মিয়ানমারেই দৃষ্টি দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

আর এ সঙ্কট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিলের ঘাটতির প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক।

তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অর্থ দেওয়ার কথা বলছে, কিন্তু ছাড় করছে না। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে অনেক। তারা কেবল মুখেই বলছে।”

এ সঙ্কটের প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে গিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বঞ্চনার ইতিহাস এবং বিভিন্ন সময়ে তাদের বাংলাদেশে আসার বিষয়গুলো বলেন।

তিনি বলেন, এবার রোহিঙ্গারা এসেছে খুব কম সময়ের মধ্যে। মাত্র তিন মাসের মধ্যে প্রায় ছয় লাখ মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। নতুন জন্ম নেওয়া শিশুদের সংখ্যা বাদ দিয়েই তাদের সংখ্যা সাত লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হওয়ার পর ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতির অগ্রগতি হয়নি।

“সমস্যাটা আসলে রাজনৈতিক, আর সেই সমস্যা মিয়ানমারের রাজনৈতিক কাঠামোতে, যেটা মূলত উর্দিধারীরা চালায়। তারা নির্মম, আইনের শাসনের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধা নেই।”

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, তিন মাসে যারা এসেছে, তাদের ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা হয়েছে দুই বছরের মধ্যে। সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তদারকির কথাও রয়েছে।

“আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বাংলাদেশ কি এই দুই বছরের জন্য স্কুল করবে? কীভাবে এটা হবে? তাদের শিক্ষা দরকার। কিন্তু এটা বেশ কঠিন।”

অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন ডয়চে ভেলের এশিয়া বিভাগের প্রধান দেবারতি গুহ

আলোচনার এক পর্যায়ে ডয়চে ভেলের এশিয়া বিভাগের প্রধান দেবারতি গুহ বলেন, শিক্ষা কেবল বইয়ের মাধ্যমে নয়, কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও হতে পারে।

অনির্দিষ্টকালের শরণার্থী জীবনে কর্মহীন রোহিঙ্গা তরুণদের মধ্যে যে উগ্রবাদের বিস্তার ঘটতে পারে, সে বিষয়ে সতর্ক করেন ইনেস পোল।

তিনি বলেন, “আমাদের এমন কিছু ভাবতে হবে, যাতে তাদের কর্মহীন বসে থাকতে না হয়। তারা সুস্থ, সবল, আর শক্তিশালী। তারা কিছু করতে চায়। তারা চায়, জীবনটা যেন অর্থহীন না হয়। এটা তাদের জীবনের প্রশ্ন। আমার মনে হয় এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে।”   

রোহিঙ্গা শিশুরা যেন একটি যথাযথ শৈশব পেতে পারে, সে ব্যবস্থা করার ওপর জোর দেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

তিনি বলেন,“তাদের সামনে কিছু থাকতে হবে যাতে তারা এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে। বাস্তবতা হল, মিয়ানমার সরকার যে আচরণ করছে, তাতে রোহিঙ্গাদের অপেক্ষা অনেক দীর্ঘ হয়ে যেতে পারে।”

হত্যা-ধর্ষণের মত ভয়ঙ্কর যেসব ঘটনা এই শিশুদের দেখতে হয়েছে, সেই ক্ষত সারানোর বিষয়েও আরও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন বলে তৌফিক ইমরোজ খালিদী মনে করেন।

তিনি বলেন, “আমাদের মধ্যবিত্ত, শহুরে মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চ শ্রেণির মাঝেও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা অনেক কম। এমনকি আমাদের আমলারাও এ বিষয়ে খুব একটা দৃষ্টি দেন না। তারা ভাবেন, আমিতো এই ছেলেকে খাবার দিয়েছি, এটা-সেটা দিয়েছি। আমার কাজ শেষ। কিন্তু করার আরো অনেক কিছু আছে।

“এই শিশুরা যদি স্বাভাবিক মানুষের মত বড় না হতে পারে, সেটা আমাদের সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর হতে পারে।”

 

অনুষ্ঠান শেষ করার আগে দেবারতি গুহ বলেন, “প্রথমে অন্তত এটা মেনে নিতে হবে যে, তারা এখানে আছে। তাদের একটা ভবিষ্যত আছে। তাদের জন্য স্যানিটেশন, ট্রমা সেন্টার, নারী বান্ধব স্থান দরকার।

“অন্তত এতটুকু নিজেদের বলা দরকার যে, তারা এখানে দীর্ঘ মেয়াদে এখানে থাকবে। তাদেরকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে দেখতে হবে, যাতে তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হয়, বিকশিত হওয়ার সুযোগ হয়।”

জার্মানির আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টার ডয়চে ভেলে কাজ করে ৩০টি ভাষায়। এর মধ্যে জার্মান ও ইংরেজিতে টেলিভিশন সম্প্রচারের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ভাষার রেডিও রয়েছে। সব ভাষাতেই রয়েছে অনলাইন সংবাদ সেবা। দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলে ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদকের এটাই প্রথম সফর।

ডয়চে ভেলের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বিপণন কর্মকর্তা টবিয়াস গ্রোডে বেফেরবর্গ ছাড়াও বাংলাদেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক এবং কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ও ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগ অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে।