রোহিঙ্গাদের সহায়তার কথা মুখেই বলছে বিশ্ব: তৌফিক ইমরোজ খালিদী

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের সহায়তার কথা কেবল ‘মুখেই বলছে’, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ তারা দিচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Oct 2018, 10:56 AM
Updated : 13 Oct 2018, 05:19 PM

বাংলাদেশ ও জার্মানির শরণার্থী সমস্যা নিয়ে শনিবার ঢাকায় ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোলের সঙ্গে এক আলোচনায় রোহিঙ্গা সঙ্কট প্রলম্বিত হওয়া প্রসঙ্গে তার এ মন্তব্য আসে। 

জার্মানির আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টার ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে এস তার অভিজ্ঞতার কথা এই আলোচনায় তুলে ধরেন। আর তৌফিক ইমরোজ খালিদী বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ সঙ্কট নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণগুলো বলেন।

রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিতে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, গত মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা একশ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ৩৮ শতাংশ জাতিসংঘ হাতে পেয়েছে।    

“আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অর্থ দেওয়ার কথা বলছে, কিন্তু ছাড় করছে না। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে অনেক। তারা কেবল মুখেই বলছে।”   

বাংলাদেশ যেখানে সীমিত সম্পদ আর নানা সীমাবদ্ধতার পরও মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে, সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এমন সাড়া পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলবে বলে মনে করেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।     

ইনেস পোল মনে করেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে একটি সুযাগ পাওয়া উচিত

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের শুরু মিয়ানমারে, সেখানেই খুঁজতে হবে সামাধান

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর দীর্ঘদিন ধরেই জাতিগত নিপীড়ন চলে আসছে। বিভিন্ন সময়ে সহিংসতার মুখে সেখান থেকে পালিয়ে এসে চার লাখের বেশি মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে কয়েক দশক ধরে।

এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সেনা অভিযান শুরু হলে বাংলাদেশ সীমান্তে আবারও রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। জাতিসংঘের হিসাবে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা গত এক বছরে বাংলাদেশে এসেছে।

দুই প্রধান সম্পাদকই বলেছেন, এ সঙ্কটের সমাধান যে সহজে হচ্ছে না, তা তারা বুঝতে পারছেন। 

ইনেস পোল বাংলাদেশ সরকারকেও বিষয়টি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান এবং রোহিঙ্গাদের সমাজের মূল ধারায় নিয়ে আসার পরামর্শ দেন, যাতে তারা শিক্ষা আর কাজের সুযোগ পায়। বাস্তুচ্যুত এই জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া উচিত বলেও মত দেন তিনি।

 

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করছে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ হিসেবে। সরকারের এই অবস্থানের সঙ্গে তিনি একমত, কারণ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের বর্ণনা করে ‘বাঙ্গালি’ হিসেবে।  

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন ইতিহাসের প্রেক্ষাপট থেকে।

তিনি বলেন, ১৯১১ সালের আদমশুমারিতে রোহিঙ্গাদের ভারতীয় বংশোদ্ভূত একটি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, কারণ বার্মা তখন ভারতের অংশ ছিল। ১৯২১ সালে তাদের বলা হল আরাকানি। রাখাইনের আরেক নাম হল আরাকান।

“১৯৮২ সালে হঠাৎ করেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব আর সব অধিকার ছেঁটে ফেলা হল। অথচ তারা হল সেই জনগণ, যারা পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছে, তাদের অনেকে মন্ত্রী হয়েছেন। তাদের অনেকে বার্মার শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ছিলেন।

“এই মানুষগুলো ফিরে যাবে না, যদি তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিয়ে কোনো ধরনের কাগজ না দেওয়া হয়।”

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা সঙ্কটের মোকাবেল করছে, পশ্চিম ইউরোপে জার্মানিকেও তখন শরণার্থীদের স্রোত সামলাতে হচ্ছে।

ভাগ্য বদলের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপমুখী এই জনস্রোত চলছে গত কয়েক বছর ধরে। তাদের মধ্যে ১০ লাখের বেশি মানুষ ইতোমধ্যে আশ্রয় পেয়েছে জার্মানিতে।

পূর্ব ও পশ্চিমের দুই দেশ একই সময়ে কীভাবে শরণার্থী সঙ্কটের মোকাবেলা করছে, এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথে চ্যালেঞ্জগুলো কী- সেসব বিষয়ে মত বিনিময় করতেই এ আলোচনার আয়োজন করেছিল ডয়চে ভেলে।

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, জার্মানি বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই অনেক বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে জার্মানির পার্থক্য অনেক। এখানে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বাস্তবতা পুরোপুরি আলাদা।  

তিনি বলেন, এডিবি ও বিশ্ব ব্যাংক রোহিঙ্গাদের সহায়তায় তিন বছর মেয়াদী প্রকল্প নিয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার যে চুক্তি করেছে, সেখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শেষ করতে দুই বছরের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।

“আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক- সব পর্যায়ের আলোচনাতেই এটা আসছে যে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থান আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।”

তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, নিজের দেশে অধিকারবঞ্চিত রোহিঙ্গারা যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা পেরিয়ে এসেছে, তাতে তারা ভাবছে, বাংলাদেশে ক্যাম্পের অবস্থা যেমনই হোক, রাখাইনের পরিস্থিতির চেয়ে তা ভালো।

তবে ক্যাম্পের পরিবেশে রোহিঙ্গা শিশুরা যেভাবে বেড়ে উঠছে, তা নিয়ে আরও ভাবার ওপর জোর দেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক।

তিনি বলেন, এই শিশুদের চোখের সামনে তাদের মা-বাবাকে হত্যা করা হয়েছে, পরিবারের মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়েছে। মানসিক ধাক্কা সামলে উঠতে মনোবিদের সহায়তাও তাদের দরকার। 

“কিন্তু যেভাবে তারা বেড়ে উঠছে, তা শেষ পর্যন্ত সমাজের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।”