নিমতলী দেউড়ি এখন ঐতিহ্য জাদুঘর

মুঘল স্থাপত্যের বিলুপ্তপ্রায় নিদর্শন নিমতলী প্যালেসের নিমতলী দেউরি এখন ‘ঐতিহ্য জাদুঘর’ হিসেবে স্মৃতি নিদর্শন বয়ে বেড়াবে প্রজন্মান্তরে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Oct 2018, 02:58 PM
Updated : 12 Oct 2018, 02:58 PM

বাংলাদেশ  এশিয়াটিক সোসাইটির প্রাঙ্গনে ধ্বংসপ্রাপ্ত এই স্থাপত্যটিকে নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে গড়ে তোলা এই জাদুঘরে প্রদর্শিত হবে বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা নির্দশন।

বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে এই ঐতিহ্য জাদুঘরটির উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি মাহফুজা খানমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সাব্বীর আহমেদ।

মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “জাদুঘর সকলের সহযোগিতা ছাড়া গড়ে ওঠতে পারে না। এটি অমূল্য সম্পদ। এর মূল্য দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের এখনো গড়ে ওঠেনি।”

ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন স্থানে ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা উপাদান সংরক্ষণের কাজটি করতে গিয়ে আর্থিক সঙ্কটের পাশাপাশি জনগণের সচেতনতার অভাবের কথাও বলেন মন্ত্রী।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন জাদুঘর সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমেদ ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হাফিজা খাতুন।

দুঘর সম্পর্কে পরিচিতিমূলক বক্তব্য রাখেন এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘরের প্রধান গবেষণা সমন্বয়ক শরীফ উদ্দিন আহমেদ।

ঐতিহ্য জাদুঘরে উপহার হিসেবে বিভিন্ন নিদর্শন দেওয়া ব্যক্তি ও পরিবারকে সম্মাননা সনদ দেন করেন সংস্কৃতি মন্ত্রী। সম্মাননা গ্রহণকারী পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন আবদুস সালাম।

ঢাকার ৪০০ বছর উপলক্ষে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে বাংলার নবাবদের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থাপনা ‘নিমতলী দেউড়ি প্রাসাদ’।

ঢাকার আলোচিত নবাব পরিবারের ব্যবহৃত ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে এই জাদুঘরের জন্য।

জাদুঘরের প্রধান গবেষণা সমন্বয়ক শরীফ উদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিমতলী প্রাসাদে বসবাসকারী নায়েব-নাজিমদের জীবনযাত্রা, শিক্ষাযাত্রা, শিক্ষা-সংস্কৃতি তুলে ধরা হবে এ জাদুঘরে।

১৭১৭-১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নায়েব-নাজিমদের শাসনকালের কালানুক্রমিক তালিকা, বিশিষ্ট নায়েব-নাজিমদের পোর্ট্রেট (যারা এই প্রাসাদে বসবাস করেছেন), বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীর আঁকা ঈদ, মহররম ও জন্মাষ্টমীর মিছিলের চিত্রকর্ম ছাড়াও নিমতলী দেউড়ি চিত্র (সংস্কারের আগে ও পরে ) প্রদর্শন করা হচ্ছে।

১৭৬৬ সালে নির্মিত ঢাকার নিমতলীর প্রাসাদের নহবতখানা সংবলিত তোরণদ্বার এবং বারদুয়ারি নামে দরবার গৃহের কিছু অংশ ছাড়া বর্তমানে এর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

যদিও এককালে এখানে ছিল হাতিশালা, ঘোড়াশালা, সৈন্য-সামন্ত, পাইক-বরকন্দাজ, নকিব-নফর। ছিল বিভিন্ন হর্ম্যরাজি ও নায়েব-নাজিমদের প্রাসাদ, হারেম (অন্দরমহল), রাজপুরুষ ও সরকারি অমাত্যদের জন্য বালাখানা, দপ্তর, কাচারি প্রভৃতি। আরও ছিল খাজাঞ্চিখানা, নকিবদের নহবতখানা এবং সেনাছাউনি।

অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের অন্যতম লক্ষ্য থেকে একে একটি শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এশিয়াটিক সোসাইটি ও গবেষকদের জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা এবং গবেষণার অন্যতম কেন্দ্র ছাড়াও এটি পর্যটকের অনুসন্ধিৎসুতার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। সাধারণ ঐতিহ্যপিয়াসী নাগরিক দর্শক, ঢাকাপ্রেমিক, গবেষক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অতীত ঐতিহ্য তুলে ধরা এ জাদুঘরের মূল উদ্দেশ্য।”

জাদুঘরটিকে মূলত ভিজুয়াল ফর্মে রূপান্তরিত করা হবে। সেখানে থাকবে সব রকম তথ্য।

তবে খুবই পুরনো স্থাপনাটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় একসঙ্গে ১৫ জনের বেশি দর্শনার্থীকে এখানে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ন্যূনতম দর্শনীর বিনিময়ে এ জাদুঘর পরিদর্শন করা যাবে।

এরই মধ্যে ঢাকার নামজাদা কয়েকটি পরিবারে ব্যবহৃত ৩৩টি ঐতিহাসিক নিদর্শন এ জাদুঘরে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এগুলোর বয়স প্রায় ১১৭ বছর।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা শায়লা পারভীন তার সংগ্রহে থাকা ১৯০০ শতকের ফল কাটার ছুরি-চাকু ও কাঁটাচামচ দিয়েছেন।

পুরান ঢাকার প্রসিদ্ধ পরিবার মীর আশরাফ আলীর অষ্টম প্রজন্ম সৈয়দ আবেদ হাসান এই জাদুঘরের জন্য চীনামাটির প্লেট, কারি ডিশ, রাইস ডিশ ও নান্দনিক একটি গহণার বাক্স দিয়েছেন, যেগুলো এখন আর কোথাও দেখা যায় না বা অবশিষ্ট নেই।

জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পরিবারটির জাহানারা ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার ঐতিহ্য ও পারিবারিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে আসছে।

সম্প্রতি ফাউন্ডেশনের সভাপতি জিনাত পারভীন ঢাকার প্রসিদ্ধ পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত ২৬টি নিদর্শন দান করেছেন জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। নিদর্শনগুলো হল- এখলাই, শাড়ি, শাল, চীনামাটির প্লেট, বাটি ও স্যুপপাত্র, ধাতব কেটলি, ট্রে, কলস, হুক্কার খোল, ঝাড়বাতি, প্রদীপ বা মোমদান, কাঠের বাতি, ঘণ্টা, টোকরা, কাচের কুপি, হরিণের শিং ইত্যাদি।

সম্ভাব্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে- পানদান, আতরদান, পানের কৌটা, অলঙ্কৃত গহনার বাক্স, খাসদান, গাড়ু, ফুলের সাজি, গ্লাস, হুক্কা, গোলাপ পাশ, পালকি, খড়ম, হাতপাখা, দলিল/দস্তাবেজ/দলিলের অধ্যায়/ফরমান, সিঁদুরের কৌটা, আফতাবা, চীনামাটির পাত্র (ডিশ, প্লেট, ফুলদানি, কারি ডিশ, টিফিন ক্যায়িরার বা বাক্স, বাসনকোসন, জার, ফানুস, চিমনি); বাদ্যযন্ত্র (বেহালা, ম্যানডোলিন, পিয়ানো, পাখোয়াজ ও গ্রামোফোন); পোশাক-পরিচ্ছদ (চোগা, শাল, জামদানি শাড়ি, মসলিন, চাপকান, কানপোস ও শতরঞ্জি); নকশিকাঁথা (দস্তরখান, মোটা কাঁথা); কাঠের শিল্পকর্ম (পালঙ্ক, বেড়া, সিন্দুক, ঢেঁকি ও ভাস্কর্য); মিনিয়েচার পেইন্টিং, চিত্রকলা, তলোয়ার, খেলাধুলা সরঞ্জাম, নির্দেশাবলি/আদেশ, নায়েব-নাজিমদের আলোকচিত্র/প্রতিকৃতি, মুদ্রা/নোট ইত্যাদি।

এসব নিদর্শন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া যাবে।