২১ অগাস্ট: অবসান ঘটছে বিচারের অপেক্ষার

ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ১৪ বছর আগে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীবিরোধী সমাবেশে নৃশংস যে গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল, তার বিচার মিলতে যাচ্ছে বুধবার।   

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Oct 2018, 05:38 PM
Updated : 10 Oct 2018, 06:10 AM

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার ঘটনায় বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ ৪৯ আসামির সাজা হবে কি না- সেই সিদ্ধান্ত এদিন ঘোষণা করবে আদালত।

হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা আলোচিত দুই মামলায় যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন গত ১৮ সেপ্টেম্বর রায়ের এই দিন ঠিক করে দেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ওই গ্রেনেড হামলার ঘটনা ছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত।

আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সে সময় ছিলেন বিরোধী দলীয় নেতা। আর সেই সময়ের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এখন কারাগারে দুর্নীতি মামলার সাজা ভোগ করছেন। 

এ মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ওই হামলা চালানো হয়। হামলায় অংশ নেয় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি) জঙ্গিরা। আর তার পেছনে ছিল তখনকার চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড আনা হয় পাকিস্তান থেকে।

আওয়ামী লীগের অভিযোগ, বিএনপি আমলে ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে নানা চেষ্টা হয়। হামলার পরপরই নষ্ট করে ফেলা হয় আলামত।

পরে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নতুন করে তদন্ত শুরু হলে ‘প্রকৃত তথ্য’ বেরিয়ে আসতে থাকে। উদঘাটিত হয় ‘জজ মিয়া নাটক’।

দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজার রায় মাথায় নিয়ে তারেক রহমান আছেন যুক্তরাজ্যে

অন্যদিকে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বিএনপি বলে আসছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে করা অধিকতর তদন্তে তাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেককে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে।

খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই হরকাতুল জিহাদের নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন,খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউক এবং গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই  ও পুলিশের শীর্ষ পদে থাকা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এ মামলার আসামি।

দুই মামলায় মোট ৫২ আসামির বিচার শুরু হলেও অন্য মামলায় তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় মোট ৪৯ আসামির রায় হচ্ছে বুধবার।  হত্যা মামলায় তাদের সবার নাম থাকলেও বিস্ফোরক আইনের মামলায় তাদের মধ্যে ৩৮ জন আসামি।

আসামিদের মধ্যে ২৩ জন আগে থেকেই কারাগারে ছিলেন, যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে আদালত জামিনে থাকা আটজনকেও কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।তারেক রহমানসহ বাকি ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার কাজ চলে।

দণ্ডবিধি এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের যেসব ধারায় দুই মামলার বিচার হয়েছে, তাতে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তারেক রহমানসহ ৩৮ আসামির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড এবং ১১ সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ডের রায় আসতে পারে।

১৮ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্কের শুনানির শেষ দিনে আসামিপক্ষ দাবি করে, প্রসিকিউশনের হাতে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে ওই ঘটনায় এ আসামিরাই জড়িত ছিল। এর ভিত্তিতে আসামিদের খালাস দেওয়ার আর্জি জানান তাদের আইনজীবী।

অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলার প্রধান কৌঁসুলী সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, হামলার ঘটনায় আসামিদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সাক্ষীদের বক্তব্যেই উঠে এসেছে। এর ভিত্তিতে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে দাবি করে তিনি আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান আদালতের কাছে। 

ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন,এ রায় রাজধানীতে কোনো নিরাপত্তা হুমকি তারা দেখছেন না। তারপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে থাকবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও রায় ঘিরে সারাদেশে দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন।

আর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, রায় কী হয়, তা দেখার পর তারা কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

সেদিন যা ঘটেছিল

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রা হওয়ার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের মাঝখানে একটি ট্রাক এনে তৈরি করা হয়েছিল মঞ্চ।

শোভাযাত্রার আগে সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বক্তৃতা শেষ করে তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার সময় ঘটে পর পর দুটি বিস্ফোরণ।

এরপর সামান্য বিরতি দিয়ে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ শুরু হয়। তারই মধ্যে শোনা যায় গুলির আওয়াজ।

গ্রেনেড হামলায় রক্তাক্ত নেতা-কর্মীরা; এদের অনেকের জীবনে ফেরা হয়নি

ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরা তখনও ভয়াবহতার মাত্রা বুঝে উঠতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এগোতেই তারা দেখতে পান শত শত জুতো, স্যান্ডেল রাস্তায় ছড়ানো। তারই মধ্যে পড়ে রয়েছে মানুষের রক্তাক্ত নিথর দেহ; আহতদের আর্তনাদে ভয়াবহ এক পরিস্থিতি।

হামলায় আহতদের সাহায্য করতে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাকর্মীরা যখন ছুটে গেলেন, তখন পুলিশ তাদের ওপর টিয়ার শেল ছোড়ে। পুলিশ সে সময় হামলার আলামত সংগ্রহ না করে তা নষ্ট করতে উদ্যোগী হয়েছিল বলেও পরে অভিযোগ ওঠে।

ওই হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ জন আহত হন।

মঞ্চে উপস্থিত নেতাকর্মীরা বিস্ফোরণে মধ্যে মানববর্ম তৈরি করায় সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়।

২১ অগাস্ট: জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজার আশায় আহতরা

‘আইভী রহমানের চোখে সেই শূন্য দৃষ্টি আমি ভুলতে পারি না’

২১ অগাস্ট: যেভাবে সেদিন রক্ষা পান শেখ হাসিনা

সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।

২১ অগাস্ট হামলায় নিহত অন্যরা হলেন শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।

সেদিনের সেই হামলায় আহত অনেকে আজও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছেন। তারাও আশা করছেন, ১৪ বছর পরে হলেও তারা সুবিচার পাবেন, হামলায় জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা হবে।

মামলা বৃত্তান্ত

হামলার পরদিন মতিঝিল থানার তৎকালীন এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। থানা পুলিশ, ডিবির হাত ঘুরে সিআইডি এই মামলার তদন্তভার পায়।

ঘটনার চার বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির।

জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে সেখানে আসামি করা হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে তাদের বিচারও শুরু হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে।

সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় আরও ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন।

সেখানে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ চার দলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নাম আসে।

আবদুল কাহার আকন্দ

সৈয়দ রেজাউর রহমান

২০১২ সালের ১৮ মার্চ সম্পূরক অভিযোগপত্রের আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। নতুন করে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। রাষ্ট্রপক্ষের ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে মোট ২২৫ জন এ মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন।

জামিনে ও কারাগারে থাকা ৩১ আসামির সবাই আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তাদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন ২০ জন।

রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিশেষ এজলাসে ১২০ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে মামলা দুটি রায়ের পর্যায়ে আসে।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু জানান, দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক আইনের দুই মামলার বিচার কাজ একই সঙ্গে চলে। সব মিলিয়ে মোট ১ হাজার ৪৫৪ কার্যদিবস আদালত বসেছে এ মামলা শোনার জন্য।

মামলার সাক্ষীদের মধ্যে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ১৪ জন। আর আসামিদের মধ্যে ১৩ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

তদন্ত ভিন্ন খাতে, জজ মিয়া ‘নাটক’

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে এ মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল বলে অধিকতর তদন্তে উঠে আসে। জানা যায়, হামলার বিষয়ে নোয়াখালীর জজ মিয়ার ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দেওয়ার বিষয়টি ছিল নাটক।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলে আসছেন, বিএনপি-জামায়াত জোট হামলার পর থেকেই তদন্ত বাধাগ্রস্ত করতে কাজ শুরু করে। এমনকি শুরুতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে করা মামলাও পুলিশ নেয়নি। বরং হামলার অনেক আলামত সে সময় নষ্ট করে ফেলা হয়। 

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নেতারা সে সময় ওই হামলার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করেন। প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ওই হামলায় জড়িত বলেও সে সময় প্রচার চালানো হয়।

হামলার পর বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল চারদলীয় জোট সরকার। ৪০ দিনের মাথায় ওই কমিশনের দেওয়া ১৬২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশি একটি গোয়েন্দা সংস্থা ওই হামলায় জড়িত।

পরের বছর নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়।

আদালতে সেই সাজানো জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদের নির্দেশে তিনি পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে অন্যদের সঙ্গে ওই হামলায় অংশ নেন।

কিন্তু বিএনপির সেই সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে ২০০৬ সালের অগাস্টে জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তার ছেলে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে সিআইডিই তাদের ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছিল। জজ মিয়াকে রাজসাক্ষী হওয়ারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।

ঘটনার চার বছর পর তদন্তে হাত দিয়ে আবদুল কাহার আকন্দ এই হামলার পেছনের ঘটনা তুলে আনেন, দেন সম্পূরক অভিযোগপত্র। সেখানে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে গ্রেনেড হামলার পুরো ঘটনাই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।

সিআইডির এই কর্মকর্তার তদন্তেই শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এই মামলায় তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের সম্পৃক্ততা উঠে আসে।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল যুক্তিতর্ক শুনানিতে বলেন, অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে এ মামলায় মূল রহস্য উদঘাটন হয়েছে। ঘটনার পরিকল্পনাকারীদেরও ওই অভিযোগপত্রে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

“দেশ তখন পরিচালিত হচ্ছিল হাওয়া ভবন থেকে। হাওয়া ভবনের নেতৃত্বে ছিলেন তারেক রহমান। তিনি যেভাবে চালাতেন, সেভাবে কাজ হত। তারেক রহমান পাওয়ারে থাকায় ওই কুটিল চক্র তার কাছে যায়। আর ওসব ব্যক্তির (জঙ্গি) সঙ্গে তারেক রহমানের সুসম্পর্ক থাকায় তারা সম্মিলিতভাবে ক্ষমতার থাকার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় সুবিধা দিয়ে ওই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।”

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আসামিপক্ষ দুই মামলায় মোট পাঁচবার উচ্চ আদালতে যাওয়ায় এ বিচার মোট ২৯২ কার্যদিবস বিলম্বিত হয়েছে।  তারা যুক্তিতর্ক উপস্থাপনেও কালক্ষেপণ করেছেন।

এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কারণে মামলার বিচার বিলম্বিত হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ ২২৫ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে, জেরা হয়েছে, এটা অবশ্যই সময় সাপেক্ষ। কোনো কিছু সংক্ষিপ্ত করার সুযোগ ছিল না।”

হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান দিয়ে যান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি

আসামি যারা

এ মামলায় মোট ৫২ জনের বিচার শুরু করেছিল আদালত। অন্য মামলায় তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় ২১ অগাস্টের মামলায় মোট ৪৯ জনের রায় ঘোষণা করবে আদালত।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া তিনজনের মধ্যে সাবেক জোট সরকাররের মন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।

এছাড়া অন্য মামলায় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল রাতে।

মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ‘প্রশাসনিকভাবে ওই হামলার পরিকল্পনা’ এবং আসামিদের ‘পালাতে সহযোগিতা’ করেন।

মুদ্রা পাচারের এক মামলায় সাত বছর এবং জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজার রায় মাথায় নিয়ে তারেক রহমান দেশের বাইরে পালিয়ে আছেন গত দশ বছর ধরে। তিনিসহ ২১ অগাস্ট মামলার ১৮ আসামি এখনও পলাতক।

মামলা দুটিতে তারেক রহমানসহ ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০ বি, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩০২, ১০৯ ও ৩৪ এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩, ৪ ও ৬ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়।

এরমধ্যে ৩০২ ধারায় মানুষ হত্যার অভিযোগে এবং ১২০-বি ধারায় হত্যার অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।

আর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩ ধারায় প্রাণহানির জন্য এবং ৬ ধারায় অর্থ, পরামর্শ ও বিস্ফোরক দিয়ে সহায়তার জন্য একই শাস্তির বিধান রয়েছে।

হারিছ চৌধুরী ও শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ

মোহাম্মদ হানিফ ও মাওলানা তাজউদ্দিন

এই ৩৮ আসামি হলেন- বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ, বিএনপির সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হানিফ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহিম ও রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, হরকাতুল জিহাদ নেতা আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মাদ ওরফে জিএম, শেখ আব্দুস সালাম, কাশ্মিরী নাগরিক আব্দুল মাজেদ ভাট, আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মাওলানা ইয়াহিয়া, মাওলানা আব্দুর রউফ ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, বাবু ওরফে বাতুল বাবু, মুফতি হান্নানের ভাই মুহিবুল্লাহ মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাইদ ওরফে ডাক্তার জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলুবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, শাহাদত উল্যাহ ওরফে জুয়েল, হোসাইন আহমেদ তামিম, মাইনুদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, আরিফ হাসান সুমন, মো রফিকুল ইসলাম সবুজ, মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন, পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুনছালিন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার ও লিটন ওরফে মাওলানা লিটন।

আসামিদের মধ্যে ১১ সরকারি কর্মকর্তার বিচার হয় আসামিদের প্রশ্রয় দেওয়া এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ অদৃশ্য করে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করার মত অভিযোগে, দণ্ডবিধির ২০১, ২১২ ও ২১৭ ধারায়।

তাদের মধ্যে সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা ও শহিদুল হক, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক এটিএম আমিন আহমদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদারের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২১২ ও ২১৭ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এ দুই ধারায় দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

পুলিশের সাবেক উপ কমিশনার (পূর্ব) মো. ওবায়দুর রহমান, উপ কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাইদ হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়  দণ্ডবিধির ২০১, ২১২ ও ২১৭ ধারায়। এই তিন ধারায় সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

এছাড়া সাবেক আইজিপি (ঘটনার সময় অতিরিক্ত আইজিপি) খোদা বক্স চৌধুরী এবং তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান এবং এএসপি আব্দুর রশীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় দণ্ডবিধির ২১৮ ও ৩৩০ ধারায়। এ দুই ধারায় সর্বোচ্চ তিন ও সাত বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

পলাতক ১৮ আসামি

তারেক রহমান ছাড়া এ মামলার পলাতক আসামিরা হলেন- হারিছ চৌধুরী, সেনা কর্মকর্তা এটিএম আমিন আহমদ ও সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, সাবেক সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা খান সাঈদ হাসান ও ওবায়দুর রহমান খান, হরকাতুল জিহাদের নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মুরসালিন ওরফে মুরসালিন, মোহাম্মদ খলিল, জাহাঙ্গির আলম বদর, ইকবাল, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা লিটন ওরফে দেলোয়ার হোসেন ওরফে জোবায়ের, মুফতি শফিকুর রহমান ও রাতুল আহমেদ বাবু ওরফে রাতুল বাবু। তাদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশে আটক হয়েছেন বলে মনে করা হয়।