শিল্প মালিকদের কাছে সরকারের নতি স্বীকার: প্রতিক্রিয়া শ্রমিক নেতাদের

ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে অধিকাংশ শ্রমিক সংগঠন।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2018, 04:39 PM
Updated : 13 Sept 2018, 07:31 PM

তারা বলেছে, এর মধ্য দিয়ে শিল্প মালিকদের কাছে নতি স্বীকার করল সরকার।

১৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও চেয়েছেন তারা।

তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থক শ্রমিক নেতারা মজুরি বোর্ডের ঘোষণা মেনে নিয়েছেন।

১৬ হাজার টাকা মজুরি দাবি আদায় না হওয়ার জন্য শ্রমিক সংগঠনগুলোর অনৈক্যকে দায়ী করেছেন মজুরি বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি বেগম শামসুন্নাহার ভূঁইয়া।

আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগের এই নেতা মজুরি বোর্ডে আলোচনার সময় ১২ হাজার টাকা মজুরির প্রস্তাব তুলে অন্য সংগঠনগুলোর তোপের মুখে পড়েছিলেন।

শামসুন্নাহারকে মজুরি বোর্ডে নেওয়া নিয়ে তখন আপত্তিও জানিয়েছিলেন বামপন্থি শ্রমিক নেতারা।

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের প্রায় ৪০ লাখ কর্মীর জন্য ২০১৩ সালে সরকার ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেছিল।

পাঁচ বছর পর গত জানুয়ারিতে নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের পর অধিকাংশ সংগঠন ১৬ হাজার টাকা ন্যূনম মজুরির দাবি তোলে।

সৈয়দ আমিনুল ইসলাম নেতৃত্বাধীন এই মজুরি বোর্ড মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পর বৃহস্পতিবার ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে।

মজুরি বোর্ডের সদস্যদের নিয়ে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু নতুন বেতন কাঠামোর ঘোষণা দিয়ে বলেন, “আশা করি, মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষ এটা মেনে নেবে।”

তবে মজুরি বোর্ডের সভা চলার মধ্যেই ১৬ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে বিক্ষোভ করছিল বাম সমর্থিত শ্রমিক সংগঠনগুলো।

সচিবালয়ে প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণার পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ করে ১৬ হাজার টাকার দাবিতে প্রায় দুই বছর ধরে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে আসা শ্রমিক সংগঠনগুলো।

সিপিবি সমর্থিত গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি জলি তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার মাধ্যমে শ্রমিকদের সাথে অন্যায় করেছে। আমরা ঘৃণা ভরে এই মজুরি প্রত্যাখ্যান করলাম।”

এর প্রতিবাদে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রসহ অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনগুলো জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শুক্রবার সমাবেশ করবে বলে জানান তিনি।

সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলমও এক বিবৃতিতে শ্রম প্রতিমন্ত্রী ঘোষিত নিম্নতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করেন। শ্রমিকদের আকাঙ্ক্ষা ও বাজার দরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ১৬ হাজার টাকা মজুরি ঘোষণার দাবি জানান তারা।

১৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ের নিচে বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভ করছিল শ্রমিক সংগঠনগুলো

পোশাক শ্রমিক নেতা মোশরেফা মিশু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মজুরি কাঠামার মাধ্যমে শ্রমিকদের আকাঙ্ক্ষার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে মালিকরা, তাদের সাথে যোগ দিয়েছে সরকার।”

মজুরি বোর্ডে আলোচনায় পোশাক শিল্প মালিকরা ৬ হাজার ৩০০ টাকা নিম্নতম মজুরি প্রস্তাব করেছিল।

মিশু বলেন, “আমরা বহুবার মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়ে সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, বিজিএমইএ-বিকেএমইএতে অনেকবার আমরা প্রতীকী অনশন করে বোঝানোর চেষ্টা করেছি।

“আমরা বোঝাতে চেয়েছি, বর্তমান বাজারে ১৬ হাজার টাকা না হলে একজন শ্রমিকের ৬ সদস্যের একটি পরিবার চলে না। কিন্তু কোনো যুক্তিকে তোয়াক্কা না করে এই মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে।”

“মালিকরা না হয় মজুরি বাড়াতে চায়নি, কিন্তু সরকার কিভাবে এমনটি করতে পারল, আমরা বুঝলাম না। এটা অসম্ভব ব্যাপার, আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিনা, এই মজুরি আমরা প্রত্যাখ্যান করি,” বলেন মিশু।

গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সদস্য সচিব জুলহাসনাইন বাবু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এটা প্রত্যাখ্যান করেছি, মেনে নিতে পারছি না। কারখানা মালিকদের পক্ষেই গেছে এই মজুরি কাঠামো।

“শ্রমিকরা ১৬ হাজার টাকা চেয়েছে, সেখানে দেওয়া হল ৮ হাজার টাকা। উপরন্তু মালিকরা সরকারের কাছ থেকে উৎসে কর, করপোরেট কর কমিয়ে আনাসহ বিভিন্ন সুবিধা আদায় করল।”

তিনি বলেন, “শ্রমিকদের চাহিদার স্পিরিটের সাথে প্রধানমন্ত্রী গেলেন না। আমরা আবারও মজুরি বাড়ানোর দাবি করছি। যেহেতু এটা প্রস্তাব আকারে আসছে, এখনও প্রজ্ঞাপন হয়নি, তাই মজুরি বাড়ানোর সুযোগ আছে।”

১৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে ছিল শ্রমিক সংগঠনগুলো

১২টি সংগঠনের জোট গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের সমন্বয়কারী মাহবুবুর রহমান ইসমাইল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এই মজুরি মানি না। আগামীকাল আমরা প্রতিবাদ কর্মসূচি করব। আশা করি, প্রধানমন্ত্রী আমাদের দাবি পুনর্বিবেচনা করবেন।”

বিএনপির শ্রমিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৮ হাজার টাকা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাস্তবতার নিরিখে এটা পোশাক শ্রমিকদের সাথে তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়।

“স্কপসহ আমরা যারা ট্রেড ইউনিয়ন করি, তারা প্রথম থেকে দাবি করে আসছি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা। বর্তমান বাজার দর এবং অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলের নিরিখে আমাদের এই দাবি ছিল। অথচ সেই দাবিকে পাশ কাটিয়ে এই ঘোষণা হয়েছে। শ্রমিকদেরকে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।”

নতুন মজুরি কাঠামো নিয়ে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু

এই শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে শ্রমিক লীগের সভাপতি শুক্কুর মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। সরকার শ্রমিকবান্ধব সরকার। যা করেছে তা শ্রমিকদের ভালোর জন্যই করেছে।”

তবে পোশাক শ্রমিকদের সাথে কথা না বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি তিনি।

শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ফজলুল হক মন্টু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সরকারের কাছে ন্যূনতম ১২ হাজার টাকা করার দাবি করেছিলাম। আমাদের দাবি বেশি থাকলেও সরকার কিন্তু ৫ হাজার থেকে এক সঙ্গে আট হাজার টাকা করেছে, এটা কিন্তু কম নয়।

“আমাদের খেয়াল রাখতে হবে এটা কিন্তু ব্যক্তি মালিকানার প্রতিষ্ঠান, ইচ্ছে করলেই বাড়িয়ে দেওয়া যায় না। জননেত্রী শেখ হাসিনা মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেই আট হাজার টাকা নির্ধারণের সুযোগ করে দিয়েছেন, এছাড়া কোনোভাবেই আট হাজার টাকাও সম্ভব ছিল না।”

‘দাবি জোরাল ছিল না’

শ্রমিক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও মজুরি বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি শামসুন্নাহার ভূঁইয়া ১৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবি আদায় না হওয়ার জন্য শ্রমিক সংগঠনগুলোকেই দায়ী করেন।  

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শ্রমিকদের পক্ষে থেকে শিল্পের সক্ষমতা ও বাজারের বাস্তবতার নিরিখে আমরা ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ২০ টাকা করার প্রস্তাব করেছিলাম। সেই দাবি পূরণ হলেই খুশি হতাম। কিন্তু মালিকরা সেটাও কোনোভাবেই মানতে চায়নি।”

মজুরি বোর্ডের বৈঠকে শামসুন্নাহার ভূইয়া (ফাইল ছবি)

সরকার সমর্থক এই শ্রমিক নেতা মালিকদের সক্ষমতার বিষয়টিও দেখার পক্ষপাতি।

তিনি বলেন, “কিছু কারখানা আছে যাদের সামর্থ্য ভালো। কিন্তু অনেক কারখানা আছে, যারা মাঝারি মানের বা তার চেয়ে নিচের মানের। তাদের পক্ষে বেশি মজুরি দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না।”

অন্য সংগঠনের আপত্তির মধ্যে বোর্ডের সিদ্ধান্ত কিভাবে মেনে নিলেন- প্রশ্ন করা হলে শামসুন্নাহার বলেন, “৪০ লাখ শ্রমিকের এই সেক্টরে ১৬ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু সেই আন্দোলন জোরালো ছিল না এবং সেখানে লোকসমাগমও খুব কম ছিল। ফলে মালিকদের সাথে এনিয়ে বেশি দর কষাকষি করা যায়নি।

“আপনি নিশ্চয় আজকেও মজুরি বোর্ডের নিচে শ্রমিক উপস্থিতি দেখেছেন। এত একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে সেখানে কতজন শ্রমিক ছিলেন? এক-দেড়শর বেশি হবে। তাহলে আমরা এত অল্প লোক নিয়ে এর চেয়ে আর কী করতে পারি?”

তোপখানা রোডে মজুরি বোর্ডের কার্যালয়ের নিচে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভে শ্রমিক লীগের নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ দেখা যায়নি।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সুমন মাহমুদ ও কাজী মোবারক হোসেন]